হাফলং এর দ্বিতীয়বারের এবারের ভ্রমণটা তৃপ্তিদায়ক যেমন তেমনি নস্টালজিকও। ঝুমবৃষ্টিতে স্টেশনে দ্বিতীয়বারের মতো আগমন আগেরবারের অনুভূতির থেকে বেশ ফারাক। পাহাড়ি ঢল কিছুদিন পূর্বেই সাজানো গোছানো স্টেশনের অনেকাংশ, স্টেশন থেকে হাফলং বাজারের পাহাড়ি খাড়া রাস্তাটির অনেক জায়গায় ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে।
আগেরবারের তাড়াহুড়োর ভ্রমণটিতে এই শৈল শহরের ভাঁজ- খাঁজগুলো, যাপনের অনাবিষ্কৃত রংগুলো এইবার চেহারা পেয়েছে। এখন চোখ বুঝলেই মোড়গুলো, সন্ধ্যা, পাহাড়ের রাত, কোন চূড়াটিতে বাজার, কোনটিতে ভিউ পয়েন্ট, কোনটিতে সিনট চার্চ, চার্চের ডানে অনেক নিচে কিংবা ডানপাশ ঘেষে ডানদিকে উপরে হাসপাতাল, হাসপাতালে উঠার মুখে বাম পাশে সর্পিল গাঁ বেয়ে উঠে তারপর নিচের দিকে মন্দিরের সামনের বিশাল পাহাড় আর গিরি খাদের নির্জনতা, শহরেই ডিসি হিলের চত্বর থেকে রেলওয়ে ব্রিজ আর বিষন্ন গম্ভীর পাহাড় সারি। পাহাড়ি ঢালের সন্ধ্যার মম'র দোকান সব চারপাশে বিরাজ করে।
জাতিঙ্গা এইবার আরও মস্ত হয়েছে, আরও গম্ভীর। এইবার মনখারাপের কারণ হয়েছে গিরিন চেটিয়া লজ এর অপমৃত্যু। ভস্মরুপ স্মৃতির আগুন নিভে গেছে একেবারেই। সে পাহাড় সে লজ এখন জঙ্গলাকীর্ণ ভগ্নাংশমাত্র। কি ভীষণ দুঃখের! গিরিন চেটিয়ার গলাটি শুনতে পেলাম, বদলের ঠিকানা আরো গহিনে হওয়ায় এমনকি সেখান থেকে সংযোগও স্থাপন করা গেলো না। গিরিন চেটিয়া আজন্ম এক হারিয়ে ফেলা প্রিয়জন হয়ে গেলেন কি! জানি না।
তিনদিন ছুঁয়ে দেখে, ট্রেনের ডে অফ আর টিকিট অপ্রাপ্তির কারণে অপেক্ষমান না থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকার আকাঙ্খায় পরদিন শিলচরের ট্রেনে চেপে বসলাম। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ৪ ঘন্টা।
প্রত্যাশাতীত হয়েও, নতুন এ জনপদ মায়ার ফাঁদ বিছানো। বদরপুর থেকে বাইপাস ধরে ঘন্টা খানেক। মাঝে বিল, কচুরিপানার ফুল, শালিক, বক, মাছরাঙা। ভাঁটপাতা, শিয়ালমুতি, মাছ ধরার জাল, জংলা পাড়ের শাড়ি। প্রদেশ আলাদা হয়েও মাঝপথের এক স্টেশনের নাম অরুণাচল। অরুণাচল পার হয়ে অল্পখানি যেতেই ভিন্ন ঐতিহ্য আর ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা; ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিগাঁথা, স্টেশন চত্বরের সৌধ।
অনতিদূরে গান্ধিপার্ক আর মাঝারি বাংলা বাড়ি ছাড়িয়ে গাঙ্গিনাপাড় টু নতুন বাজার সদৃশ্য সেন্ট্রাল রোড। শিলচরের সেন্ট্রাল পয়েন্ট। এই রাস্তাতেই হোটেল স্লিপ ইন এ আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছে।
ব্যস্ত রাস্তা জুড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ নানা স্ট্রিট ফুড এর সমাহার। পাটিসাপ্টা সহ কতো পিঠার পুরনো ছোটখাটো দোকান। ফরিদপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার সহ বাংলাদেশের নানা জায়গার নামের নানা দোকান যেনো এক টুকরো বাংলাদেশ। দেশভাগের ক্ষত এখানে শুকায়নি। আরেক দূর্ভাগা পাঞ্জাবের একটা ব্যাংককেও দেখলাম। দুই দূর্ভাগা- বাংলা, পাঞ্জাব।
সুপার শপ, সিনেপ্লেক্স এর সাথে পাল্লা দিয়ে এই পথের উপরেই মাঝারি মানের হোটেল, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত সকল শ্রেণীর নানা কর্মযজ্ঞ চলছে সমানতালে। সবখানেই পূজোর ভীড়।
নামটা বিস্মৃতি হয়ে গেছে, এই পথের ই একটা খাবার হোটেল এর সরিষা ইলিশ স্থায়ী সুখস্মৃতি হয়ে গেছে। এতো তৃপ্তি নিয়ে কিছু খেয়েছি বলে তো আর মনে পড়ে না। সপ্তমীর পূজোর সন্ধ্যায় দীর্ঘ এই রাস্তার মন্ডপগুলোতে দর্শনার্থী নারীপুরুষ এর ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া, একলা হয়ে যাওয়া জগতের আনন্দ মুহুর্তগুলোর একটি। সচেতনভাবে লক্ষ করেছি মন্ডপগুলোতে বাংলা ছাড়া অন্য একটা গানও বাজেনি। এটি কি সচেতন জেদ কি না জানি না।
জীবনের বৈচিত্র, যাপনের ব্যস্ততা মন্থনে শিলচর জীবনের একটা দিন দাবি করতেই পারে। গ্ল্যামারের খুচরোর বাইরে মায়ার দৌলত বিছানো অনেক জনপদের মতোই শিলচরও মায়াময়। পরদিন সকাল ৮ টার ট্রেনে চেপে বিকেলে ত্রিপুরায় পৌছার মধ্যিখানে ক্ষণিক এই যাত্রা বিরতি কি সুখের যে হলো! পর্যাপ্ত ছবি তোলা হয়ে উঠেনি। শিলচরের একটা ল্যান্ডস্কেপ তবু মনে থেকে যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন