সময়কাল ২০২৪।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর জনাকীর্ন তিনটি পয়েন্ট ডলফিন মোড় থেকে শুরু। প্রথমটি কলাতলী শেষেরটি লাবণী আর মাঝের পয়েন্টটির নাম সুগন্ধা। সাধারণত এই তিনটি সৈকতই মানুষের গন্তব্য থাকে। এছাড়া এখান থেকে মানুষের গন্তব্য থাকে ৯০ কিমি দূরুত্বের সেন্টমার্টিন ২০ কিমি দূরের মহেশখালি ইত্যাদি জায়গা। এই তিনটি পয়েন্ট থেকে উত্তর পশ্চিশে তাকালে যে বৃক্ষের ঘনকালো ছায়ার মতো চোখে পড়ে তা ই সোনাদিয়া।
খুব কম সংখ্যক মানুষ ই হয়তো এই দ্বীপটির সন্ধান জানেন। সেই কারণ ই হয়তো এখনও এই দ্বীপটিকে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে সহায়তা করেছে।
কক্সবাজার থেকে এতো কাছে এতো চমৎকার একটি জায়গার এই প্রাকৃতিক অবয়ব কতদিন থাকবে জানিনা। ইতিমধ্যেই এখানে বিদ্যুত এর লাইন হয়ে গেছে , এই লাইন দিয়ে আসবে বিদ্যুৎ, এর পিছু পিছু আসবে ব্যাবসায়ী আর তার হাত ধরে ব্যাবসা, আর সেটিই কাল হবে এই দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও। এর মধ্যে যারা এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সান্যিধ্য পাবে তারা সৌভাগ্যবান। নির্ঝনতা এখানে নিবিড়।
এখন পর্যন্ত ৬-৭ হাজার মানুষ এই দ্বীপটিতে বাস করেন। ঝাউবন কেওড়া বনে ঘেড়া এই দ্বীপটিতে পাকা বাড়ি এখন পর্যন্ত হাতেগোনা দু’একটি। ইট, বালু, সিমেন্ট, রড সব নিতে হয় মহেশখালি থেকে। সোনাদিয়া মহেশখালি উপজেলার অন্তর্ভূক্ত। এর উত্তরে মহেশখালি, পূবে কক্সবাজার, দক্ষিণে এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। পূর্ব পাড়া এবং পশ্চিম পাড়া এই দুটি ভাগে সাধারণত দ্বীপটি বিভক্ত, সে অনুসারেই এর ডাকনাম। আয়তনে দ্বীপটি ৯ কিমি মতন হলেও নতুন নতুন ভূমি তার সাথে যোগ হচ্ছে ধীরে ধীরে।
দ্বীপে যাওয়ার সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ কক্সবাজার থেকে অটোতে ৫-৬ কিমি দূরের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শুটকি পল্লী নাজিরাটেক হয়ে।
নাজিরাটেক এর মানুষের প্রধান ব্যস্ততা মাছধরা মাছ বিক্রি, শুটকি উৎপাদন শুটকি বিক্রি কেন্দ্রিক।
![]() |
নাজিরাটেক সৈকত |
বঙ্গোপসাগরের এই মোহনা থেকে বেড়িয়েছে বাঁকখালি নদী। এই বাঁকখালি নদী দিয়েই ৬ নং ঘাট থেকে মহেশখালি-কক্সবাজার যাওয়া আসা করে দৈনিক হাজারো মানুষ। নাজিরাটেক এই বাঁকখালি পারেই কক্সবাজার বিমানবন্দর। এখানেই বিমান উড়োজাহাজ ল্যান্ডিং এর জন্য বাঁকখালির উপরেই নির্মাণ হচ্ছে রানওয়ে।
![]() |
নাজিরাটেক সৈকতে মাছ ধরার বোট |
নাজিরাটেক থেকে ছোট কমলা রঙের বোটে ১৫-২০ মিনিটে সোনাদিয়ার পূর্ব পাড়া। এখানে সুন্দর ছোট একটি পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট করা হয়েছে। পশ্চিম পাড়াতেও রয়েছে একটি রিসোর্ট।
পশ্চিম পাড়ার বিচ সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু তাতে যেতে হলে কষ্ট করে যেতে হবে। এই দ্বীপের রাস্তা বলতে হাঁটা পথ। কোন অটো রিক্সা বা কোন বাহন নেই। পশ্চিম পাড়া থেকে পূর্বপাড়া কিংবা পূর্ব পাড়া যেতে হয় ২ থেকে ৩ ঘন্টা হেঁটে।
![]() |
পশ্চিম পাড়া সৈকত |
কক্সবাজার এর ৬নং ঘাট থেকে ট্রলার বা স্পিডবোটে মহেশখালি, সেখান থেকে অটোতে ঘটিভাঙা ঘাট, যা প্রায় ১০-১২ কিমি পথ পেড়িয়ে। ঘটিভাঙা ঘাট থেকে বোটে মিনিট ৪০ এর পথ পেরিয়ে সোনাদিয়ার পশ্চিমপাড়া। সেক্ষেত্রেও আছে বিড়ম্বনা । সারাদিনে কেবল একটি বোট জোয়ারের সময় ১০-১১ টার মধ্যে। না পেলে নাই। রিজার্ভের ক্ষেত্রে ফোন নাম্বার থাকলে হয়তো ব্যবস্থা করা সম্ভব।
![]() |
ঘটিভাঙ্গা ঘাটের কমলারঙের বোট |
পূর্ব পাড়া দিয়ে দ্বীপে প্রবেশে নাজিরাটেক হয়ে গুনতে হবে ৮০০শ থেকে ১০০০ টাকা, এক কিংবা দশ যাত্রী যাই হোক। পশ্চিম পাড়া দিয়েও রিজার্ভে একই, তবে লোকালে জনপ্রতি ৫০ টাকা।
![]() |
লোকাল বোট যাত্রী |
পশ্চিম পাড়া নৌপথটি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের মতো, যত্রতত্র শাঁসমূলও দেখা যায়। ছোট বড় নানা ধরণের পাখীদের সাথে এই পথেই আমি প্রথম সারস দেখেছিলাম। নানা উপায়ে মাছ ধরার আয়োজন এই পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
![]() |
পশ্চিম পাড়ার নৌপথ |
আমরা পশ্চিম পাড়া দিয়ে প্রবেশ করে বিচ দিয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা হেঁটে পূর্ব পাড়ায় পৌছেছিলাম। বিচ ঘেষা দীর্ঘ ঝাউবনের সারি। কৃত্রিমভাবেই এই বন তৈরি হলেও তা এখন প্রকৃতির অংশ।
![]() |
সোনাদিয়ার পশ্চিম পাড়া ঘাট |
নির্জন এই দ্বীপটির কৃষি এবং সাগরে মাছ ধরা বেশির ভাগ মানুষের জীবিকার উৎস। এছাড়াও বোট চালনো, দুয়েকটি ছোট দোকান, গরু-মহিষ পালন ইত্যাদি পেশার সাথে মানুষ জড়িত। খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে চাল মাছ মাংস ডিম দুধ নিজেরাই উৎপাদন করেন। বাড়তি অংশ কক্সবাজার কিংবা মহেশখালিতে বিক্রি করেন। কাপড় কিংবা অন্যান্য নিত্যপণ্য তারা মহেশখালি কিংবা কক্সবাজার থেকে যোগাড় করেন। পূ্র্বে কেউ কেউ জলদস্যুতার সাথে জড়িত থাকলেও এখন আর তা নেই। টিউবয়েলে এখানে মিঠাপানি আসে।
এই দ্বীপটিতে একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই দ্বীপের অভিবাসীদের সন্তানদের লেখাপড়া বলতে ঐ প্রাথমিক পর্যন্তই। প্রাথমিক শেষ করে তাদের মহেশখালি কিংবা কক্সবাজারে পাঠানো হয়না উপর্জনের জন্যই। তারা পরবর্তীতে মাছধরা কাঁকড়া ধরা ইত্যাদি পেশার সাথে জড়িত হয়ে যান। চিকিৎসার জন্য এখানে কোন হাসপাতাল বা কমিউনিটি সেন্টার নেই। সপ্তাহে ১-২দিন প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তার অনিয়মিতভাবে আসা যাওয়া করেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ই সবাই। দুইটি মসজিদ আছে এখন পর্যন্ত। ভূমির কোন ব্যক্তিগত মালিকানা এখানে নেই। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বলতে বেশিরভাগ মানুষ ই দ্বীপের দুয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের কথামতই ভোট কার্যক্রমে তাদের সমর্থন প্রদান করেন।
ঝাউবনের ভিতর পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় পাড়ার দুইটি রিসোর্টে মাচা করে চালাঘর কিংবা তাবু করে থাকা রাত্রীযাপন এবং খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ১৫০০ টাকার বিনিময়ে।
নারী-পুরুষ সকলের জন্যই দ্বীপটি নিরাপদ। ক্যাম্প করে বার্বিকিউ করার ব্যবস্থা রিসোর্ট এর লোকেরাই করে দেন। পূর্বপাড়া থেকে নাজিরাটেক হয়ে কক্সবাজার ফেরার বোটও তারা যেকোন সময় ব্যবস্থা করে দেন।
সকালে বের হয়ে মহেশখালি ঘুরে ১০-১১ টার মধ্যে ঘটিভাঙা থেকে পশ্চিমপাড়া হয়ে পায়ে হেঁটে পূর্বপাড়া দিয়ে কক্সবাজার ফেরত আসা কষ্টকর হলেও এটাই এই দ্বীপকে দেখার সর্বোত্তম পন্থা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন