শনিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৯

হাফলং : পৃথিবীর এক বিষন্ন স্টেশনের শহর।





ঘুরতে যাওয়ার জন্য আসাম এর ‘হাফলং’ কোনো বিশেষ পরিচিত জায়গা নয়, আরো সঠিকভাবে বললে হাফলং এর নাম ঘুরতে যাওয়ার আগে কারো মুখে, কোনো পর্যটন বিষয়ক ব্লগে, কিংবা কোনো কাগজেও আমাদের চোখে পড়েনি।
ভারত সম্মন্ধে আমার ব্যাক্তিগত আগ্রহ তুমুল। এ আগ্রহ আরও মাদকতার পর্যায়ে পৌছে গেছে ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে ঘাটাঘাটি করার পর। আমাদের এ অঞ্চলের মূল জানতে চাইলে ভারত অধ্যয়নের বিকল্প নেই। ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে স্বল্প ঘাঁটাঘাঁটির সময়টাতে (এখনও চলমান) পড়তাম আর ম্যাপে জায়গাগুলোর অবস্থান খুঁজে খুঁজে বের করতাম। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম কোথায় কি আছে ! বাংলাদেশের চতুর্পার্শ্বে কি ! সেভেন সিস্টার কারা কারা ! আরো কত কি! এক গভীর রোমাঞ্চের ঘোরে কেটেছে সে সময় গুলো। তখন থেকেই ভারতের সবগুলো প্রদেশ, বৈচিত্রময় ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, আসবাব, পোষাক, স্থাপত্য, ভূ-প্রকৃতি, রাজনৈতিক ইতিহাস এক্সপ্লোর এর তীব্র আকর্ষণ বিরাজ করে চলেছে মন জুড়ে। 

তাছাড়া রাজনীতিবীদদের অযৌক্তিক খামখেয়ালিপনার বশে ভারত এখন আলাদা দেশ হলেও ভৌগলিকভাবে তো বাংলাদেশের সাথে ভারতের বিভাজন মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া একটি সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। ভারত পাকিস্তানের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নৃতাত্বিক সম্পর্কও। প্রতিদিনকার কর্ম কাজ আর চিন্তায় আমরা বয়ে চলেছি হাজার হাজার বছরের ভারতীয় ঐতিহ্য। যাহোক, সে ইতিহাস বলা এ লিখার মূল বিষয় নয়।
ভারতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিই দূর্গাপূজার সময়টাকে যদিও এই সময়ে ওখানে খরচ একটু বেশি হয় কিন্তু পাওয়ার পরিমাণটাও হয় কয়েকগুন, যা অন্য সময়ে অসম্ভব। কারণ এ সময়টা ওখানকার ফেস্টিভ্যাল টাইম। এই সময়টাতে ওখানে মূল বিষয়গুলো ছাড়াও বোনাস হিসাবে গোটা পরিবেশটায় থাকে আলাদা এক ফ্লেবার, পাওয়া যায় ভিন্ন এক আমেজ । চারপাশটা থাকে যা চক্চকা রঙিন এবং আনন্দময়, উৎসব মুখর। 
এবারও দূর্গাপূজার সময়টা ( ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ) ধরেই ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবি আমরা। আমি আর রুবেল ভাই মাস চারেক আগেই ত্রিপুরা ঘুরে এসেছি, অন্যরা ত্রিপুরা যাওয়ার ইচ্ছাপূষণ করলেও আমরা দু’জনে ঠিক করি ‘আসাম’টাও ঘুরে আসার। তার সাথে ত্রিপুরার কিয়দংশ। এবার আমাদের group সদস্য ছিলো ছোট বড় মিলে ( দু’বছরের আমাদের শিশু সন্তান নিসর্গ নির্জন সহ ) ৭ জন।  প্ল্যান তৈরির দায়িত্ব পড়ে আমার উপর ( এ কাজটার জন্য রুবেল ভাই সবসময় আমার উপর ভরসা রাখেন এবং আমি নিজেও এটি করে খুব আনন্দ পাই )। আমি যখন আসাম যাওয়ার রুট আর কোথায় যাওয়া যায় এমন স্থান খুঁজছি তখন হাফলং এর নামটা চোখে পড়ে। সন্ধান নিয়ে কিঞ্চিত যৎসামান্য তথ্য পাই তার মধ্যে একটি বাক্যই হাফলং যাওয়ার জন্য আমাকে উদ্বুদ্ধ করে আর তা হলো- ‘হাফলং আসামের একমাত্র শৈল শহর’।

আমি রুবেল ভাইয়ের কাছে বিষয়টা বলি এবং রুবেল ভাই যথারীতি ভরসা রাখে। পরবর্তীতে সকলের উপভোগ করা দেখে মনে হয়েছে আমাদের সিলেকশান ভূল হয় নি। তাছাড়া ফেরার সময় আমাদের মনে হয়েছে সময়টা বড্ড কম হয়ে গেলো, আরো কয়েকটা দিন থাকতে পারলে বেশ হতো। মাত্র ৫ দিনে দুই প্রদেশের কয়েকটি পর্যটন স্পট ঘুরে আসা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য জেনেও সিদ্ধান্তে অটল থাকার কারণে শিডিওল ছিলো খুব টাইড, তাছাড়া আমাদের group এ নারী শিশু উভয় ই ছিলো, তবে তারাও আমাদের সহযোদ্ধা হওয়ার কারণেই হয়তো তাদের উপর ভরসা রাখতে আমাদের দ্বিধা হয় নি।
এমনিতেই অক্টোবর মাসে দিনের দৈর্ঘ থাকে কম, ৫ টার মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসে। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে কিংবা না সেরে বেড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যায় ফেরা, কখনও বা দুপুরে ফিরে তড়িঘরি করে খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়া এবং সন্ধ্যার পরের অবস্থানরত শহরের মন্ডপে মন্ডপে বিভিন্ন  থিম এর প্রতিমা দেখা ছাড়াও আলোকসজ্জারত রাস্তায় সাজোগুজো মানুষের দলের সাথে হেঁটে ঘুরাঘুরি করে পায়ে ব্যাথা নিয়ে মাঝরাতে হোটেলে ফিরে ঘুম পরবর্তীতে পুনরায় ভোরে উঠে অন্য কোনো জায়গার ট্রেন ধরা এসবেই খুব দ্রুত কেটে গেছে আমাদের নেহাত অল্প এই ৫ টা দিন।
উত্তর পূর্ব ভারতের ৭৮, ৪৩৮ বর্গ কিলোমিটার এর রাজ্য ‘আসাম’। আসামের ২৭ টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে কম ঘনবসতিপূর্ণ জেলা ‘ডিমা হাছাও’ এর একটি শহর এবং কেন্দ্রস্থল এই ‘হাফলং’। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ এই শহরটিতে বাস করে। ‘হাফলং’ একটি ডিমাসা শব্দ যার অর্থ ‘পিঁপড়া’র পাহাড়’। অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি এখানে বাংলারও প্রচলন রয়েছে। বাঙালী ছাড়া অন্যরা বাংলায় কথা না বলতে পারলেও বাংলা মোটুমুটি বোঝেন।
মাত্র ৫০ হাজার মানুষের ১২ বর্গ কিলোমিটারের এ শহরটি পর্যটকদের জন্য যেনো কাল্পনিক স্বর্গের বাস্তবিক এক প্রতিমূর্তি দর্শন। গোটা শহরটিই ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ফুট এরও অধিক উচ্চতায় অবস্থিত।
কিভাবে যাবেন : আমরা ভারতে প্রবেশের সময়টাতে আখাউড়া আঁগরতলা স্থল বন্দর দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম। সে অভিজ্ঞতা আমি আমার ত্রিপুরা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার লিখায় শেয়ার করেছি কষ্ট করে সেটা দেখে নিলে বিস্তারিত পেয়ে যাবেন। প্রবেশের পরের প্রক্রিয়াগুলো শুধু আমি এখানে বলছি। আপনার ট্যুর পরিকল্পনায়  যদি শুধু হাফলং থাকে তাহলে আপনি আপনার মতো সাজিয়ে নেবেন। আমাদের প্ল্যানটা ছিলো ত্রিপুরার কিয়দংশ আর আসাম এর হাফলং।

তার একটা কারণও আছে। আঁগরতলা দিয়ে প্রবেশ করলে আপনাকে অবশ্যই সকাল আটটার পরে প্রবেশ করতে হবে, কারণ ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরুই হয় সকাল আটটায়। আর এসব শেষ করে আঁগরতলা শহরে প্রবেশ করতে করতে ৯ টা বেজে যাবে। কিন্তু ট্রেনে করে হাফলং যেতে চাইলে (এটাই মনে করি সবচেয়ে আনন্দদায়ক হবে) হাফলং এর ট্রেন ছাড়ে সকাল ৬ টা’র মধ্যে নেহাত দু’য়েকটা ট্রেন। তা ও আবার প্রত্যেকদিন ট্রেন থাকে না। সে কারণে আপনার পূর্বে থেকেই ট্রেনের টাইম শিডিউল সম্বন্ধে ধারণা থাকা দরকার। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে সে মতেই পরিকল্পনা সাঁজিয়েছিলাম। 

পোস্ট অফিস চৌমুহনী মোড়, আঁগরতলা।

আমাদের যেহেতু ত্রিপুরার অংশ বিশেষ হিসাবে আঁগরতলা শহর আর ঊনকোটি যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো তাই আমরা ঠিক করি আগে এই দুইটা দেখার, কারণ আমাদের মনেই হয়েছিলো ফেরার পথে ঊনকোটি নামার ইচ্ছেশক্তি আমাদের থাকবে না, তাছাড়াও একটা বিড়ম্বনাও তৈরি হবে, আর যেহেতু প্রথম দিনেই ট্রেনে চাপা যাচ্ছে না তাই আমরা প্রথম দিনটা আঁগরতলা শহর, দ্বিতীয় দিন ঊনকোটি, তৃতীয় দিন হাফলং যাওয়ার পরিকল্পনা করি। পূর্বের ত্রিপুরা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মোতাবেক আমরা গতবার মটরস্ট্যান এর যে হোটেলটাতে ছিলাম ৪০ টাকা করে রিকশা নিয়ে সেটাতে চলে যাই, তার আগে আঁগরতলা ইমিগ্রেশন ফেস করে আগের বারে অল্প কয়েক বেঁচে যাওয়া রুপিতে চা পান এবং নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য দুটো সিম কিনে নিই। হোটেলে দু’টো রুম নিয়ে আমি আর রুবেল ভাই দেরি না করে বেরিয়ে পড়ি ডলার এক্সচেঞ্জ এবং ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাঁটার জন্য। এক্সচেঞ্জ করে অটো নিয়ে আঁগরতলা স্টেশন। 

আঁগরতলা থেকে হাফলং যাওয়া আসার ট্রেন বলতে মূলত মেইল ট্রেন কাঞ্চনজঙ্গা এবং সুপার ফাস্ট হামসফার এক্সপ্রেস। আমাদের হামসফরে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ওটাতে সিট পাইনি। কাউন্টার থেকে দেখে জানালো কাঞ্চনজঙ্গায় হবে। ওখানে অগ্রিম টিকিট কাটতে ফরম পূরণ করতে হয়। এক ফরমে ৬ টি আসনের আবেদন করা যায়। আমরা এডাল্ট সদস্যও ৬ জন ই, সে হিসাবে আমাদের এক ফরম এ ই সম্ভব হলো।
দ্বিতীয় দিন যেহেতু আমাদের ঊনকোটি যাওয়ার প্ল্যান তাই ত্রিপুরার শেষ স্টেশন ধর্মনগর পর্যন্ত  ( ঊনকোটি যেতে ধর্মনগর স্টেশনে নামাই বেস্ট) আঁগরতলা টু ধর্মনগর প্যাসেঞ্জারে যাবো বলে আগেই ঠিক করেছিলাম, সেটির টিকিট তাৎক্ষনিক দেয় বলে তার টিকিট না করে তৃতীয় দিন ধর্মনগর থেকে হাফলং এবং পঞ্চম দিনের হাফলং থেকে আঁগরতলা ফেরার টিকিট এই স্টেশন থেকেই করে নিলাম। 
যাওয়ার ভাড়া পড়লো ১৫০ রুপী করে আর ফিরে আসার ২০০ রুপি করে। আঁগরতলা থেকে ধর্মনগরের দূরত্ব ১৪০ কি.মি. সময় লাগে ৪ ঘন্টা। আর ধর্মনগর থেকে হাফলং এর দূরত্ব ১৫৬ কি.মি. সময় লাগে ৫ ঘন্টা। অর্থ্যাৎ আঁগরতলা থেকে হাফলং এর দূরত্ব ২৯৬ কি.মি. সময় লাগে ৮ থেকে ৯ ঘন্টা।
প্রথমদিন আঁগরতলায় ঘুরাঘুরি আর স্বল্প প্রয়োজনীয় কেনাকাটার পর ( কারণ আমাদের টাইড শিডিউল অনুযায়ী আমরা জানতাম ফেরার পথে কেনাকাটার সময় হয়ে উঠবে না) ঘরে ফিরে সন্ধ্যাটা আঁগরতলা শহরের মন্ডপ দেখতে বের হলাম। 

মন্ডপ গেট; শান্তিপাড়া পুকুর পাড়, আঁগরতলা।


কলকাতার মতো অনবদ্য কিছু না হলেও এখানেও  এখন তৈরি হয় বিভিন্ন থিম এর দূর্গা প্রতিমা আর মন্ডপ। আমাদের হোটেলের সাথেই বড় কয়েকটা মন্ডপের প্রায় প্রত্যেকটা।

বাহুবলী-১ এর আদলে তৈরি একটি মন্ডপের বহির্ভাগ

আমরা রাত ১০ টা পর্যন্ত ঘুরেফিরে করে রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম। ভোরে ধর্মনগর যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে। দ্বিতীয় দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে অটো নিয়ে চলে গেলাম আঁগরতলা স্টেশনে ৬ টার আঁগরতলা টু ধর্মনগর প্যাসেঞ্জার ধরার জন্য। 


আঁগরতলা স্টেশন এর প্লাটফরম


পাহাড়ি পথ টানেল পাড়ি দিয়ে ( এই পথের বর্ণনাও আমার আগের ত্রিপুরার লিখায় পাওয়া যাবে ) ধর্মনগর পৌছতে আমাদের সময় লাগলো ৪ ঘন্টা। 


ধর্মনগর স্টেশন এর প্লাটফরম


বাকী সবাইকে স্টেশনে রেখে আমি আর রুবেল ভাই বেরুলাম হোটেলের খুঁজে। স্টেশনের খুব কাছে স্টেশন রোড এই একটা নতুন হোটেল পেলাম ‘নর্থ কন্টিনেন্টাল’ নামে। বেশ বড়সড় রুম, ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি করে, হয়ত শহরে আরো কমে পাওয়া যেতে পারে এমন সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে শহরের ভিতরে অন্য হোটেল খুঁজলাম প্রায় ঘন্টাখানেক ওখানে ভাড়া কম হলেও কোনোটার পরিবেশ ই ভালো না লাগায় এবং আমাদের জন্য অপেক্ষারত অন্যান্যদের মেজাজ ইতিমধ্যেই চরমে পৌছেছে কি না এমন আশঙ্কা করে ঠিক করলাম আগেরটাতেই ফিরে যাবো। সেখানে গিয়ে ১৪০০ রুপিতে দু’তলায় একটা ডাবল আরেকটা তিন বেডের বড় রুম নিয়ে নিলাম। 
ততক্ষণে আমাদের ক্ষুধার ব্যারোমিটার সপ্তমে। আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থা হলো হোটেলেই। কতৃপক্ষ জানালেন আরো কিছুটা সময় লাগবে, আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেশ খানিকটা সময় অপেক্ষার পর আর না সইতে পেরে সকলেই নেমে গেলাম নিচে। টেবিলে খাবার হওয়ার আগে থেকেই অপেক্ষা করা শুরু করলাম, কিছুক্ষণ পর সদ্য চুলা থেকে নামানো খাবার সামনে দেয়ার পর যে খাবারটা আমরা পেলাম এবং খেলাম তার স্বাদের পরিমাণ ! ওরে বাপরে ! সে কেবল খেয়েই বোঝা সম্ভব। 

ধর্মনগর স্টেশন রোড এর কাছেই জিপস্ট্যান্ড। প্রাইভেট  কারের মতো ১০ সিটের যে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় ওখানে, তা ঊনকোটি পর্যন্ত অন্য সময়ে ৬০০ ‍রুপিতে যাওয়া আসা করে। মাঝখানে আপনি এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় পাবেন, ঊনকোটি ঘুরার জন্য অতটুকুই যথেষ্ট। হোটেল এর পাশেই স্ট্যান্ড, আমরা খাওয়া শেষ করে ওখান থেকে ৮০০ রুপিতে তেমন একটা গাড়ি নিয়ে ঊনকোটি উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মাঝখানে পেরুলাম ছোট বাজার, গ্রাম, চা বাগান, আর নানা ছোট মাঝারি পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। বিশালাকার বৃক্ষ বন পেরিয়ে আমরা বিকাল নাগাদ পৌছে গেলাম ঊনকোটি। আমার আর রুবেল ভাইয়ের এ পথ পরিচিত হলেও সহযাত্রীদের কাছে নতুন এবং আগ্রহের ই ছিলো।


ঊনকোটি


ঊনকোটি দেখে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। তারপর ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় আলোকসজ্জারত রাস্তায় রাস্তায়, চারদিকে মুখরিত সঙ্গিতময় পরিবেশে মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে বেড়ানো চললো প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত।

মন্ডপের দেয়াল

আঁগরতলা ধর্মনগর আর ঊনকোটি কেবল নয় হাফলং এর বন্ধুর খাড়া পাহাড়ি পথের পুরোটা জার্নিতে আমাদের গ্রুপের কনিষ্ঠ সদস্য নির্জনও তাল মিলিয়েছে আমাদের সাথে, পড়ে গিয়ে ব্যাথাও পেয়েছে কয়েকবার, সে ব্যাথা ভূলে আবার হাঁটতেও সময় নেয়নি মোটেও। কখনও গান, কখনও ছড়ায় সে ও আনন্দ করেছে নিজের মতো করে। 
মন্ডপ দেখে রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার। আবার সেই দুর্দর্ষ স্বাদযুক্ত খাবার। তবে এবার আর আমাদের নিচে নামতে হয় নি, সকলের খাবার বয় রুমে নিয়ে আসলো। দুপুরেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলো আমরা রাতে কি খেতে চাই।  এই হোটেলের আতিথিয়তায় আমরা সকলেই দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। দারুণ একটা খাবার খেয়ে তৃপ্তি নিয়ে সকলেই ঘুমোতে গেলাম। সকালেই ধরতে হবে হাফলং এর ট্রেন। 
আমার সাধারণত সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস। দেখলাম রুবেল ভাইও সূর্য উঠার আগেই ঘুম থেকে উঠেই হাঁটতে বেরিয়ে পড়লেন। আমিও অল্প পড়ে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটা ধরলাম, দু’জন আলাদা হাঁটতে বেরুলেও স্টেশনে গিয়ে দু’জনের অনাকাঙ্খিত দেখা হয়ে যাওয়ার পর আমরা আরও অনেক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় হাঁটলাম।

ভোর আর ভোরের পরিবেশ দেখার দু’জনের একই উদ্দেশ্যে থাকলেও হাঁটতে হাঁটতে আমরা আলাপ করলাম ভারতবর্ষের নৃ-তাত্বিক পরিচয় থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, নারীবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ সহ নানা বিষয়। একটা সুন্দর ফুরফুরা মেজাজ নিয়ে হোটেলে ফিরে সকলকে তুলে ফ্রেশ হয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ বেরিয়ে পড়লাম। রাতেই ভাড়া আর দু’বেলা খাবারের খরচ মিটিয়ে দেয়ায় আর ওসবের কোনো ঝামেলা ছিলো না।
স্টেশন রোড এর এই হোটেল থেকে হাঁটাপথে স্টেশন দু’মিনিটের পথ। আমরা হেঁটেই স্টেশনের কাছের একটা হোটেলে (সকালে হাঁটার সময় এই হোটেলটা দেখে নিয়েছিলাম) লুচি আর চা খেয়ে নিলাম। 

স্টেশন রোড এ পুকুরের ধারে পরিত্যক্ত মূর্তি


তারপর স্টেশনে প্রবেশ করে ট্রেন এর জন্য অপেক্ষার ফাঁকে গাল গপ্প, চা পান, ছবি তোলা এই সব চললো। ট্রেন আসলো ৯:৩০ এর দিকে। আমাদের সিট ছিলো আলাদা দুই বগিতে । একটাতে চারটা অপরটাতে দুইটা। এলোমেলো যাতে না বেঁধে যায় সে জন্য আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম কে কোন বগিতে যাবে। দুই বগির মাঝখানে আরো প্রায় ৮ থেকে ১০ টা বগি ছিলো। আমরা কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেস এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আমাদের হাফলং যাত্রা শুরু করলাম। 
কাঞ্চনজঙ্গা নামের একটা ট্রেন নিশ্চয় যথেষ্ট সুন্দর হবে এমন ভাবনা ছিলো আমার, কিন্তু দেখলাম না এটার চেহারাও আর দশটা ভারতীয় সাধারণ ট্রেনের মতই, তবে হামসফার ট্রেন এর ভিতর আর বাহির ‍উভয় ই চমৎকার। আমরা আরেকবার হামসফরে করে দিল্লি যাবো বলে ঠিক করেছি। যেহেতু, ধর্মনগর স্টেশন ত্রিপুরার শেষ স্টেশন তাই মিনিট দশেক পরেই শুরু হয়ে গেলো আসাম, আসাম অংশের প্রথম স্টেশনের নাম ‘চড়ুইবাড়ি’। 




এরপর ট্রেন হেলেদুলে, থেমে চলে একে একে পার হলো কলকলিঘাট, পথেরকান্ডি, বাড়ইগ্রাম, নিলামবাজার। মাঝখানে পড়লো পাহাড়ি চা বাগান, আনারসের বাগান সহ নানা প্রজাতির গাছ গাছড়ার সমারোহ। এক স্টেশন থেকে অপর স্টেশনের দূরত্ব মিনিট পনেরর। এই স্টেশনগুলোতে ট্রেন থামলে আদিবাসী কিশোরী গামলা ভর্তি পাহাড়ি যে কলা বিক্রি করতে নিয়ে আসবে তা ক্রয় করে তার মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে আপনি অবাক হয়ে যাবেন, তার জন্য আপনার মনটা হুহু করেও উঠতে পারে। দেখবেন এক কাঁধি কলা এরা মাত্র ১০ রুপিতে বিক্রি করছে।
করিমগঞ্জ জেলা শহর তার নামে করিমগঞ্জ স্টেশনের নাম। এটা বাংলাদেশের সিলেটের কাছের একটি জেলা। এই স্টেশনে বেশ খানিকটা সময় পাড় করে  ‘ভাঙ্গা’ পাড় হয়ে ‘বদরপুর’ স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের ক্লান্তি যেনো আর কাটতে চায় না। পাক্কা দেড় ঘন্টা এখানে শুয়ে বসে থাকলো ট্রেন, এই স্টেশনের প্লাটফরমে ৩০ রুপিতে ডিম-পোলাও, আর ২০ রুপিতে ৩ লুচি আর আলুর দমের প্যাকেজ পাওয়া যায়-এক্সটা লুচি প্রতি পিছ ৫ টাকা। এছাড়াও নানা খাবার দাবার পাওয়া যায় এই স্টেশনে। 


বদরপুর জংশন এ খাবার দোকান

আমাদের মনে হলো যেহেতু ভোরে এই ট্রেনটা আঁগরতলা থেকে ছেড়ে আসে, সে কারণে এই স্টেশনটাতে হয়ত স্বল্প সময়ের খাবার বিরতিও দেয়। অনেককেই দেখলাম এখান থেকে নাস্তা সেরে নিলো। এছাড়াও এই স্টেশনে পৌছার ঘন্টাখানেক আগেই ট্রেনের কেন্টিন বয়রা আসবে খাবারের অর্ডার নেয়ার জন্য। বদরপুরের এই খাবার বিরতি সম্বন্ধে ধারণা না থাকায় আমরা আগেই সেখানে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলাম। সেখানে ভাতের সাথে মাছ কিংবা মাংস উভয়ই খেতে পারেন, ওটাও প্যাকেজ। ডাবল ডিম-ভাত এর প্যাকেজ ১২০ রুপি, মাছের পিস-ভাত প্যাকেজ ১৩০, চারা পোনা-ভাত এর প্যাকেজ ১৫০, আর মাংস-ভাত এর প্যাকেজ ১৭০ রুপি ছিলো, এই প্যাকেজগুলোতে ভাতের পরিমাণ খুবই কম মনে হয়েছে। আমাদের আগে বদরপুর সম্বন্ধে ধারণা থাকলে খাওয়াটা স্টেশনের এই খাবার দিয়েই সারতাম। 

লং জার্নিতে অবশ্যই ট্রেনে উঠার পূর্বে সবসময় পানি আর যথেষ্ট হালকা খাবার নিয়ে উঠতে ভূলবেন না, না হলে পরে পস্তাতে হতে পারে। এতক্ষণ ট্রেন দাঁড়ানোর সুবাদে একটাই ফল হলো রুবেল ভাই আর মাসুম এসে আমাদের খোঁজ নিয়ে গেলো। যদিও প্রতি মূহুর্তেই মনে হচ্ছিলো এই বুঝি ট্রেন ছেড়ে দেয় তবুও দেড় ঘন্টার দীর্ঘ বিরতির পর ট্রেন পুনরায় ছুটলো। ধর্মনগর থেকে যাত্রার পর পথে কিছুদূর ছোট পাহাড়ের সারি (আসলে হাফলং এর পাহাড় দেখার পর এগুলো আমাদের কাছে ছোট পাহাড়ে পরিণত হয়েছে) আর পাহাড় জুড়ে চায়ের বাগান পড়ে, সমতল ভূমি হলেও রেল লাইন যথেষ্ট উঁচুতেই। 
কাঞ্চনজঙ্গা আমাদের নিয়ে চলতে থাকলো। বদরপুর পেরোনোর পরই ভূ-প্রকৃতি যেনো এক ঝটকায় পরিবর্তন হয়ে যেতে থাকলো। কোথা থেকে যেনো বিশাল উঁচু উঁচু পাহাড় সারিগুলো ছুটে ছুটে আসতে থাকলো। চলতি পথের পাহাড়ি পাথুরে শৈল প্রপাত, পাহাড়ি নদী, ব্রক্ষপূত্র, বরাক উপত্যকা, সু-উচ্চ সবুজ পাহাড় চা বাগান কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবো ! আমরা অনুধাবন করতে লাগলাম যেনো দারুণ এক সৌন্দর্যের ভাড়ারের দিকে আমরা ছুটে চলেছি। ছোট পাহাড়ি স্টেশন ‘দামছড়া’ ট্রেন খানিক্ষণ থামলো আগত অপর ট্রেনকে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।



দামছড়া


লাইন ডাবল ট্রিপল হলেও টানেলের লাইন সিঙ্গেল। সে কারণে কোনো কোনো সময় টানেল ক্রসিং এর কারণে টানেলের পূর্বের স্টেশনে কোনো একটি ট্রেনকে থামানো হয়। দামছড়া স্টেশনটিও চমৎকার। এই হালকা করে চমৎকার বলার কারণ হচ্ছে আমাদের গন্তব্য স্টেশন ‘নিউ হাফলং’ । এই স্টেশন দেখার পরে অন্য অনেক সুন্দর আপনার গাছে গৌণ হয়ে যাবে। নিউ হাফলং দেখার আগে যখন দামছড়া স্টেশনের চারপাশটা দেখি তখন আমরা কেবল তাকিয়েই থেকেছি।
এখান থেকে ছাড়ার পর পুরোটা পথ যেতে শুধু হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড় আর পাহাড় পড়বে পথে। কখনও বা পাহাড় থেকে নেমে আসা জলের ধারায় তৈরি হওয়া নদীর ধারা, উপত্যকা। প্রকৃতির অফুরন্ত এসব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন আপনি ‘জাতিঙ্গা লামপুর’ পার হয়ে টানেল ফুরে হঠাৎ করে ‘নিউ হাফলং’ এ প্রবেশ করে ফেলবেন বুঝতেই পারবেন না। 

 
জাতিঙ্গা লামপুর

আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা ভয়ানক ই হতে পারতো। আঁগরতলার সদ্য কলেজ পরীক্ষা সমাপ্ত করে এ পথে প্রথম ট্যুরে লামডিং যাওয়া (লামডিংও দারুণ এক পাহাড়ি জনপদ) এক যুবকের সাথে আমার পরিচয় হয় কাঞ্চনজঙ্গায় (ভাবতে খারাপ লাগছে যে, আমি তার নামটা মনে রাখতে পারিনি )। দরজায় দাঁড়িয়ে সে ক্যামেরায় একের পর এক দৃশ্য বন্দি করছিলো। খানিকসময় আমি আমার কলেজ সময়ের ফ্ল্যাশব্যাক তার মধ্যে যেনো পাই, কপর্দকশূণ্য অথচ ঘুরে বেড়ানোর তীব্র আকাঙ্খা, বিনাখরচেও সম্ভব ভ্রমণ উপযোগী ট্রেন সার্ভিসকে আমাদের ভ্রমণ পথ হিসাবে বেছে নেয়া তবুও ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। আলাপ প্রথমে ক্যামেরা বিষয়ক থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা আঁগরতলার রাজনীতি, দেশভাগ ইত্যাদি বিষয়ে চলে যায়। ওর দাদুও বাংলাদেশ থেকেই এসেছে বলে জানালো।


চারপাশের বিশাল বিশাল পাহাড় আর টানেল এর মধ্য দিয়ে চলতে চলতে স্বল্প সময়েই আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা তৈরি হয়। আলাপরত সম্পুর্ন অপ্রস্তুত আমি ট্রেনটা টানেল ফুরে একটা স্টেশনে থামলে নামতে চাওয়া যাত্রীদের একজনকে সাধারণ আগ্রহবশে শুধু জিজ্ঞেস করি এই স্টেশনটার নাম কি ? সে যে জবাব দেয় তা যেনো আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয়ার মতো কাজ করে, আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না সেটার জন্য, তিনি বলেন- নিউ হাফলং। আমার তো ঘাম ছুটে অবস্থা, একমূহুর্ত দেরি করলে কিংবা আগ্রহবশে জিজ্ঞেস না করলে আমরা নামতেই পারতাম না। তারপর একপ্রকারের দৌড়াদৌড়ি করে ব্যাগসহ নিজেরা নামি। ওদিক দিয়ে চিন্তায় আমি অস্থির ওরা জানে কি না আমাদের যেখানে নামার কথা এটাই সেই স্টেশন! নামবে কি না ! আমি নেমেই ব্যাগের কাছে আমার সহযাত্রীকে রেখে দে দৌড়। 
ডি-১ কামরায় পৌছাতে হবে, কিন্তু সে তো অনেক দূর ! দৌড়ানো শুরু করলাম, মিনিট খানেক দৌড়ে কামরার কাছে পৌছে কামরাতে নেই দেখেও কেবল মনে হচ্ছিলো নামতে পেরেছে কি ! এই কামরাতে ছিলো ! না কি ট্রেন অপেক্ষাকৃত খালি দেখে ইচ্ছেমত কামরায় বসে গেছে ! নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাশের কামরাগুলোও খোঁজে দেখলাম, আবার দৌড়ে আগের জায়গায় এসে দেখি সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে, দেখে হাঁফ ছেড়ে দুঃশ্চিন্তামুক্ত হলাম। আর সেই দুঃশ্চিন্তামুক্তির বিশ্রামের সুযোগে যে নতুন শঙ্কার পথ তৈরি হচ্ছে তা টের পেতে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেলো।
ট্রেনটা প্লাটফরম ত্যাগ করলো। বদরপুরের যাত্রাবিরতির কারণে ট্রেন ১ ঘন্টা লেটে ৩:৩০ এ পৌছলো। পাহাড়ি জনপদে সন্ধ্যা নামে সমতলের আগে। আমরা জানিনা কোথায় যাবো ? কোথায় থাকবো ? কিভাবে যাবো ? রুবেল ভাই প্রস্তাব করলো চা পানের এবং ফাঁকে আলাপ করে চা ওয়ালার থেকে প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন নিতে চেষ্টা করার, তাই করলাম। 
এখানে প্লাটফরমে ট্রেন আসার আগ মুহুর্তে দোকানীরা দোকান খুলে আবার ট্রেন প্লাটফরম ত্যাগ করার সাথে সাথে দোকান গুটিয়ে ফেলতে থাকে। সারাদিনে দু’চারটা ট্রেন। গুটিয়ে ফেলার মুহুর্তে এক দোকানির কাছে আমরা চা চাই। আগের প্রাপ্ত তথ্যমতে ভেবেছিলাম এখানে বাঙালী নেই কিংবা এখানকার মানুষ বাংলা বুঝে না। কিন্তু চেহারায় বাঙালী মতন দেখতে চা ওয়ালা থেকেই বুঝতে পারলাম, না এখানে বাঙালীরাও আছেন। ইতিমধ্যেই মিনিট দশেক পাড় হয়ে যাওয়ার পর, চা ওয়ালা চা পানের ফাঁকে যে তথ্যটা দিলেন  তা আমাদের চিন্তার রেখাপাত হওয়া, আর চোখা-চোখি করার জন্য যথেষ্ঠ। চা কোনো মতন শেষ করে দ্রুত স্টেশন থেকে বের হতেই চা ওয়ালার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হতে চললো। একটাও অটো নেই শহরে যাওয়ার। সব যাত্রী নিয়ে চলে গেছে। 
আসলে এই স্টেশনটা পাহাড়ের অনেকটা উপড়ে হলেও শহরের পাদদেশে অবস্থিত। মূল শহরের দূরত্ব এখান থেকে আরও ১০ কিলোমিটার এবং পুরোটাই সর্পিলাকারে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে আরো অনেকটা উপরে উঠতে হয়, অর্থ্যাৎ এই স্টেশনটা শহরের এবং জনপদের একেবারে বাইরে।  
একজন স্থানীয় সম্ভবত স্টেশন সংশ্লিষ্ট শ্রমিক জানালেন অটো পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে ট্রেনের সময়মত অটো আসে, ট্রেন চলে গেলে যাত্রি নিয়ে ফিরে যায়। আজ যেহেতু আর ট্রেন নেই তাই অটোও আর আসবে না। তিনি জানালেন না আসলেও সমস্যা নাই, চাইলে স্টেশনে থেকে যেতে পারেন। এখানে পেমেন্ট করে থাকার ব্যাবস্থা আছে, সে জন্য টিকিট কালেক্টরের সাথে আলাপ করতে হবে (পরে খুঁজ নিয়ে জেনেছি মাত্র ১০০ রুপিতে এখানে থাকার ব্যাবস্থা আছে)। আমাদের চিন্তার রেখা আরো গাঢ় হলো। অটোর জন্য স্থানীয় কয়েকজন আদিবাসীদের অপেক্ষা অবশ্য কিছুটা আশাও যোগাচ্ছিল। কি করবো ভাবছি আর পাহাড়ের গাঁ বেয়ে উঠে যাওয়া রাস্তাটার দিকে বার বার তাকাচ্ছি। 
আমরা স্টেশনের সামনেই অপেক্ষারত ছিলাম। এরই মধ্যে দু’য়েকটা অটো আসলো, আমাদের মধ্যে আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠলেও আমাদের থেকে এগিয়ে যাওয়া যাত্রীদের তুলে নিয়ে সেখান থেকেই ঘুরে চলে গেলো, স্টেশন অব্দি যাত্রী নেয়ার জন্য তার আসার ই প্রয়োজন পড়লো না। এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে একটা কিছু করার জন্য তিনজন তিন দিকে মুভ করলাম সমাধানের জন্য।

নিউ হাফলং স্টেশন এর বহির্ভাগ

শহর থেকে ফোন দিয়ে অটো আনানো যায় কি না এমন প্রক্রিয়া খোঁজা সহ দুইজন সামনের দিকেও এগোলো যাতে পরবর্তীতে অটো আসলে আমরা ধরতে পারি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা একসাথে যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করলাম। ইতিমধ্যে একজন অটোওয়ালার মাধ্যমে শহর থেকে অটো আনানোর জন্য ফোনও দেয়া হলো যা পরবর্তীতে বিড়ম্বনারও কারণ হয়েছিলো ( পরবর্তীতে ঐ অটো এসেছিলো ঠিকই, কিন্তু এর আগেই রুবেল ভাই রা অন্য অটোতে তিন সিট পেয়ে যাওয়ায় ওটাতে চলে আসে )। একটা অটোতে আমরা তিনজন চলে গেলাম পরে বাকীরা অন্য অটো দিয়ে আসে।
আমরা তাদের জন্য অপেক্ষা না করে হোটেল খুঁজতে শুরু করি। যে ৪-৫ টা হোটেল শহরে আছে তন্মধ্যে দু’টো তে সিট খালি নেই একটিতে আকাশচুম্বি ভাড়ার কারণে সেগুলোতে না উঠার কথা ভাবি। পুঁজোর সময়টাতে এই অবস্থাই হয়। এদিকে রাত হয়ে যাচ্ছে টেনশানে আছি, রুম না পেলে কি হবে এই আশঙ্কায় ! মনস্থির করি তাড়াতাড়ি করতে হবে এবং কন্ডিশন কিংবা দরকষাকষির অবস্থার সময় এটা নয়;  রুম পেলেই হলো, না হলে খোলা আকাশের নিচে রাত কাঁটাতে হবে। শেষ যে হোটেলটাতে যাই তার নাম ‘ লেক ভিউ লজ ‘, যাওয়ার আগেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম রুম খালি পেলেই হলো । সেটাতে গিয়ে যে দুটো রুম খালি পাই তার মধ্যে একটা আরও পরে ছাড়বে বলে জানায় ম্যানেজার, আর একটাতে দুই সিট অপরটাতে তিনটা, দুই রুম এর ভাড়া ২২০০ রুপি, ৫ জনের সিটে এক্সটা একজন থাকলে আলাদা ২০০ রুপি। এছাড়া কোনো পথ খোলা নেই আমরা সেই কন্ডিশনেই রাজি হয়ে যাই। আমাদের প্রত্যেকটা হোটেলে অটোওয়ালাই নিয়ে যায়। অটোওয়ালা নিজে খুঁজে দেয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখালেও আমরা ছেড়ে দেয়ার পক্ষে ছিলাম, ছেড়ে দিয়েছিলামও। কিন্তু অটোওয়ালা ছেড়ে দেয়ার পরও দাঁড়িয়ে থাকে, না থাকলে যে সমস্যায় পড়তাম পরে বুঝতে পারি। একে তো পাহাড়ি খাড়া ঢালু শহর, যেখানে হেঁটে ব্যাগ সহ মুভ করা প্রায় অসম্ভব তার উপর হোটেলগুলোর লোকেশন অপরিচিত। যা হোক কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে অটোওয়ালাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম, যাওয়ার আগ মুহুর্তে অটোওয়ালা তার নাম্বার দিয়ে গেলো (পরবর্তীতে যা আমাদের বেশ কাজে দিয়েছিলো) যেনো কোথাও গেলে অটোর প্রয়োজন পড়লে আমরা তাকে ডাকি।
হাফলং এ স্বাগতম : বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ হাফলং এ যান, তাহলে বলবো আলাদা করে কি দেখবেন তা আসলে বলার অপেক্ষা রাখে না। ওখানে যা আছে আপনি আসলে আলাদা করে ঠিক করতে পারবেন না কি দেখবেন কি দেখবেন না। গোটাটাই দেখার মতো। যেদিকে তাকাবেন আপনার চোখ সৌন্দর্যের ঢালি নিয়ে ফিরবে, যেদিকে তাকাবেন আপনার মন বিমোহিত হয়ে যাবে। এমনকি মানুষ, এমনকি প্রকৃতি যা আছে সব। আপনি মূলত সৌন্দর্যেই থাকবেন। তবুও আলাদা করে যদি বলতে হয় তাহলে বলবো। নিউ হাফলং স্টেশনটার কথা। 

চারদিকে পাহাড়ঘেরা নিউ হাফলং স্টেশন


আপনি ট্রেনে গেলে (আমরা ট্রেনে গিয়েছিলাম) এই স্টেশনেই আপনার হাফলং এ প্রথম পা পড়বে। আর পা ফেলে তাকিয়ে আপনি যা দেখবেন পৃথিবীর আর কোথাও এমনটি আছে কি না আমার জানা নেই, বর্ণনায় কিংবা দু’য়েকটা ছবি দিয়েও আসল চিত্রটা আপনাকে স্পষ্ট বোঝাতে পারা মুশকিল ; আপনি চোখ ফেরাতে পারবেন না। এই স্টেশনটা চতুর্পাশে একেবারে টাইড ল্যান্ড লক্ড। চারপাশে হাজার হাজার ফিট উচ্চতার বিশাল সবুজ পাহাড়, মাঝখানে কেবল স্টেশনটা, স্টেশনটা ছাড়া আর কিছু নেই এই পাহাড় বেষ্টিত জায়গাটুকুতে। এই স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ করলে তাকে ঐ বিশাল পাহাড়গুলোর ভিতর দিয়ে সুরঙ্গ পথ কেটে বানানো টানেল দিয়ে ৫-৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় আবার অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরোবার ক্ষেত্রে ঐ একই রকম টানেল দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। যেনো কৃত্রিমভাবে চারটি পাহাড় বসিয়ে তৈরি করা চৌকো আয়াতক্ষেত্র। আর স্টেশনের ভিতরভাগের সারা স্টেশন জোড়াি আদিবাসী জীবন যাপন আর সংস্কৃতির নানা রঙের নানা প্রতিকৃতিতে ভরপুর।


নিচে স্টেশন

পড়ন্ত বিকেলে আপনার পৌছানোর মূহুর্তটাতে সূর্য যখন হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে তখন সবুজ পাহাড় চূড়াগুলোতে মেঘ মিশ্রিত সোনালী এক আভা পড়ে, এই দৃশ্যটা স্টেশন থেকে তো দেখবেন ই অটো বা জিপ নিয়ে আপনি যখন পাহাড়ের গায়ে তৈরি মসৃন সর্পিলাকারের রাস্তা বেয়ে উপড়ে উঠতে থাকবেন তখন আরো স্পষ্ট হয়ে দেখা দেবে; চোখ ফেরাতে পারবেন না, কারণ যত উপরে উঠছেন সুন্দরের ভাঁজগুলো গভীর থেকে আরও গভীরতর হয়ে ফুঁটে উঠবে, উঁচু থেকে আরও উঁচু পাহাড়ের স্তরগুলো আরো স্পষ্ট হতে থাকবে।
স্টেশনে নেমেই আরো একটা চমৎকার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন আপনি। দেবীপ্রসাদ পড়ার মাধ্যমে আগেই জেনেছিলাম আসাম এর অনেকাংশে পারিবারিক ব্যাবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। এই মাতৃতান্ত্রিক ব্যাবস্থার একটা খন্ডচিত্র এই স্টেশনেই দেখতে পাবেন, স্টেশনে যতগুলো দোকান আপনার চোখে পড়বে, বিশেষ করে আদিবাসিদের, দেখবেন থার্মোকলের পাত্রে ডিম পোলাও ছাড়াও পাহাড়ি আনারস, কমলা, কলা সহ অন্যান্য সামগ্রিগুলো নিয়ে বসা দোকানীদের প্রায় ৯০ ভাগ নারী। কোনোটাতে পুরুষ পেলেও সে পুরুষ হয় দোকানীর বাবা নয় তো ভাই বা স্বামী গোত্রীয় কেউ একজন, যারা মূল দোকানী নয়; সহযোগী মাত্র। পরে হাফলং শহর কিংবা জাতিঙ্গা যেখানেই যান না কেনো এই একই চিত্র দেখতে পাবেন। 


 
নিউ হাফলং স্টেশনে দোকানের সারি
আমরা পরে লক্ষ করেছি পিতৃতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় যেমন পুরুষ সকালে এসে দোকান খুলে বসে রাতে আবার দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরে এখানে এই প্রক্রিয়াটাই চলমান, এখানে কর্তা হিসাবে তা করে থাকে নারী। হয়তো তার বোন কিংবা মেয়ে তাকে বিভিন্ন সময় এসে সহযোগীতা করে।




আমরা এই ব্যাবস্থা এবং আমাদের পিতৃতান্ত্রিক ব্যাবস্থার তূলনামূলক যে আলোচনা বা বিশ্লেষণ যুক্তি তর্ক সাপেক্ষে করেছি নিজেদের মধ্যে তাতে আমরা এই বিষয়টাতে একমত হয়েছিলাম যে, মাতৃতান্ত্রিক ব্যাবস্থা পিতৃতান্ত্রিক ব্যাবস্থার মতন নিপীড়নমূলক নয়। এখানে সম্পত্তির মালিক নারীরা, বিবাহ উত্তর পর্বে পুরুষ স্বামী তার জ্ঞাতি গোষ্ঠির ভিটা ত্যাগ করে নারী স্ত্রী’র ভিটায় চলে আসে; ঠিক আমাদের ব্যাবস্থার মতন, তবে লিঙ্গটা কেবল আলাদা।

স্টেশন থেকে শহরে পৌছানোর মূহুর্তটাতে আমাদের মনে হয়েছে, এই পথটা অটোর নয়, হুড খোলা জীপ থাকলে চারপাশ সহজে দেখে দেখে যাওয়া যেতো। কারণ ৪০ থেকে ৫০ মিনিটের শহরে যাওয়ার এই খাড়া পথটার চারপাশ অকৃপন সৌন্দর্যে ঠাঁসা।
কোথায় কোথায় যাবেন : এখানে দু’য়েকটি ছাড়া শহরের সেন্ট্রাল পয়েন্ট থেকে ১ থেকে ২  কিলোমিটার আশপাশেই সবগুলো উল্লেখযোগ্য স্পট এর অবস্থান। এগুলো হলো – শহরে অবস্থিত লেক, বাঘেটার এর দেবী মন্দির (২ কিলোমিটার), ফিয়াংফুই গির্জা ( ৩ কিলোমিটার), মোলকল গ্যালারী (১ কিলোমিটার), সিনট গ্যালারী (১/২ কিলোমিটার, এখানের সৌন্দর্য দেখতে আপনাকে রাতের বেলায় যেতে হবে), সলটিলার শিব মন্দির ( ১২ কিলোমিটার), শহরেই অবস্থিত টাউন কালিমন্দির, আর রয়েছে জাতিংঘা ( ৭ কিলোমিটার )।
কোথায় কি আছে এ তথ্যগুলো আমাদের পূর্বে থেকেই জানা ছিলো না, আসলে এ বিষয়ক কোনো সোর্স ও আমরা পাই নি। এ ব্যাপারে আমরা সহযোগীতার জন্য মেইন রোড হাফলং এ অবস্থিত শিপ্রা মেডেকেল হল এর রাহুল আর তার বাবার কাছে কৃতজ্ঞ। এ তথ্যগুলো সংগ্রহের জন্য গ্রুপের অন্য সদস্যদের রেখে আমি আর রুবেল ভাই বের হই, ছিমছাম শহরের খাঁড়া পাহাড়ি রাস্তার উপর দিকে হাঁটা ধরি। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন সামগ্রির দোকান, মটর স্ট্যান্ড পেরিয়ে একটা মোড়ে এসে ডিউটিরত ট্রাফিক পুলিশের সাথে কয়েকটা বিষয় নিয়ে কথা বলার ফাঁকে তার কাছ থেকে একটা বিশেষ তথ্য পাই যে, কাল বিসর্জন এর জন্য ‘নো এন্ট্রি’ থাকতে পারে এবং রাস্তায় অনেক ভীড় হতে পারে। একটু ডিটেল তথ্যের জন্য  যখন আমরা বাঙালী কাউকে খুঁজছিলাম তখন শিপ্রা মেডিকেল হলের ভদ্রলোককে বেছে নিই, আলাপের মিনিট খানেকের মধ্যে ভদ্রলোকের ছেলে আমাদের সমবয়সী হাস্যোজ্জল রাহুল আসলে সে বেশ আন্তরিকতার সাথেই সবগুলো তথ্য আমাদের দেয় এবং কো-ইনসিডেন্টলি আসলে আমরা একজন সত্যিকারের পর্যটককেই যেনো পেয়ে যাই।
জিপ গাড়ি লাগলে তার ব্যাবস্থা করে দেয়া ছাড়াও যে কোনো সহযোগীতার জন্য আমরা তার সাথে যোগাযোগ করতে পারি বলে সে তার নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে আমাদের আশ্বস্থ করে। রাহুলের কাছে যে সহযোগীতাটা পাই তাতে আমাদের বেশ একটা সাহস ই হয় বলবো। এতক্ষণের অপরিচিত জায়গাটাকে এখন আর একেবারে অপরিচিত মনে হয় না। রাহুলের সাথে এসব বিষয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে আসামের এন.ও. সি নিয়ে চলা বর্তমান সংকট এবং আসামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে বিভিন্ন ভাষাভাষির অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। জানতে পারি তার ঠাকুরদা ৪৭ এর পরে সিলেট থেকে আসামে আসে, সে জানায় তার পরিবারের নামও প্রথমবার এন.ও.সি থেকে বাদ পড়েছিলো এবং এতে করে তখন কি ভয়ানক দুঃশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে তাদের দিন কেটেছে , পরবর্তীতে আবার যে তালিকা প্রকাশ হয় তাতে তাদের নাম আসায় এই ভয়ানক যন্ত্রনার রুদ্ধশ্বাস অবস্থা থেকে তারা মুক্তি পায়। আলোচনার ফাঁকে রাহুলের মা আর তাদের পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য আসলে আমরা তাদের সাথে পরিচিত হই, তারা মন্ডপ পরিদর্শনে বের হয়েছে। জিপের বিষয়ে রাহুল জানায় ৫ জনের সিট, সবগুলো স্পট ঘুরিয়ে দেখালে ১৮০০ রুপি ভাড়া পড়বে। আমরা সব তথ্য নিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অন্য সদস্যরা। 

রুম থেকে বেরিয়েই আমরা কয়েকটা মন্ডপে ঘুরে বেরিয়েছিলাম। আমরা আমাদের ঘুরাফেরার নানা পরিকল্পনা সাঁজাতে সাঁজাতে অন্যদের কাছে চলে আসি এবং সবাই একসাথে গিয়ে পুণরায় দারুণ এক সুস্বাধু রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরি। আমাদের সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যায় পরের দিন ভোরে। আমি রুবেল ভাই আর মাসুম বাকীদের ঘুমে রেখে ভোর দেখার জন্য বের হই। বাহিরে ঠান্ডা, কুয়াশা। টি-শার্টের উপর শার্টটা চাপিয়ে লেক ভিউ হোটেল থেকে আমরা বেরিয়ে বাম দিকে রাস্তা ধরে নামতে থাকি, মিনিট খানেক হাঁটার পরেই হাফলং লেক। এই লেকটা পাহাড়ের তিন হাজার ফিট উপরে ভেবে রোমাঞ্চ অনুভূত হয় আমাদের। লেকের পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে লেকটা পাড়ি দিয়ে একটা খাড়ি বেয়ে উঠে পাহাড়ের বাঁকটা পেরিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেই আমরা বড় রাস্তাটায় উঠে যাই। এ রাস্তা বেয়েই আমরা উঠেছিলাম। রাস্তাটা যেনো টেনে আমাদের নিচের দিকে নিতে থাকে। চারদিকে গিরিখাদগুলো কুয়াশায় টইটুম্বুর হয়ে এক একটা লেকের বিভ্রম তৈরি করেছে। স্বল্প ঠান্ডায় মৃদ্য রোদের আঁচ আমাদের শরীরে ঊম ঝোগাতে থাকে, আমরা হেঁটে চলি। সামনেই ছোট একটা পাহাড়ি বসতি বাজার।




 দোকানগুলো এখনও না খুললেই একটা নাস্তার দোকান খোলা পেয়ে সেখান থেকে আমরা লুচি চা খেয়ে পুনরায় হাঁটা শুরু করি। কি এক নেশা যেনো আমাদের পেয়ে বসে। 



জাতিঙ্গা এ পথ ধরেই ৮ কিলোমিটারের মতো রাস্তা, আমরা ইতিমধ্যেই ২ কিলোমিটার এর মতো রাস্তা পেরিয়েছি। শেষ প্ল্যান আমাদের অটোতে ঘুরার থাকলেও হঠাৎ করেই মনে হয়, বাকীটা পথ হেঁটেই চলে গেলে কেমন হয় ! যেই ভাবা সেই কাজ, প্রত্যেকেই হাঁটাটা যেহেতু উপভোগ করছিলাম তাই হঠাৎ করেই জাতিঙ্গা পর্যন্ত হাঁটার কথা মাথায় রেখেই পরবর্তীতে হাঁটতে থাকি। খাড়া একটা বাঁক, গির্জা আর একটা পরিত্যক্ত দোকান পেরিয়ে আমরা একটা ভিউ পয়েন্ট এর কাছে চলে আসি। 


আব্রাহাম ভিউ পয়েন্ট


গতকাল যাওয়ার পথে অনেককেই এই ভিউ পয়েন্ট থেকে পাহাড় দেখতে দেখেছিলাম। এর মধ্যে পরিত্যক্ত দোকানের ব্যাঞ্চিটাতে বসে আমরা খানিক্ষণ জিড়িয়ে নিই। আব্রাহাম ভিউ পয়েন্ট এর এই জায়গাটাই উঠে পাহাড়ের যে ভিউ দেখি এক কথায় বলতে গেলে ‘মারভেলাস’। এখান থেকে পাহাড়ের যেহেতু একটা বিশেষ সৌন্দর্য দেখা যায় বুঝতে পারলাম এ কারণেই এখানে বিশেষ করে ভিউ পয়েন্ট টা বানানো হয়েছে। বিশাল ফাঁকা একটা স্থানের পরেই অনেকগুলো সু-উচ্চ পাহাড়ের থরে থরে সাঁজানো লেয়ার। 
ভিউ পয়েন্ট থেকে নেমে মিনিট খানেক হাঁটতেই দুটো রাস্তা দু’দিক দিয়ে ভাগ হয়ে চলে গেছে দেখতে পাবেন, নিচের দিকের রাস্তাটির উপরে একটা বড় সাইনবোর্ডে লিখা আছে ‘নিউ হাফলং’। 





এ পথ দিয়ে নিচের দিকে গেলে আপনি নিউ হাফলং স্টেশনে পৌছে যাবেন (এই পথটা দিয়েই আমরা উঠে এসেছিলাম)। আর যে রাস্তাটা উপরের ডান দিকে চলে গেছে এটা জাতিঙ্গা’র রাস্তা। এখান থেকে জাতিঙ্গা আর নিউ হাফলং স্টেশনের দূরত্ব প্রায় সমান; ৪ কিলোমিটার। আমরা ইতিমধ্যেই ৪ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে এসেছি। 
এখানেই ভিউ পয়েন্ট আর এই রাস্তাটার সাথেই দেখতে পাবেন ‘রাণী গাইডিনলিও’ এর স্ট্যাচু।




রাণী গাইডিনলিও ব্রিটিশ বিরোধী সশস্র বিপ্লবী। ব্রিটিশরাজ তাকে ‘টেরর অব নর্থ ইস্ট’ নামে চিহ্নিত করেছিলো। এই মহান বিপ্লবীর কর্মের প্রতি আপনা থেকে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসবে আপনার মন।
জাতিঙ্গার পথ ধরে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। দূর পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি নদীর ধারা, গিরিখাদ বন বনানী দেখে আসার মুহুর্তটাতে আমরা আরও একটা জিনিস লক্ষ করলাম, এই দূর্গম পার্বত্যের পুরো জনপদটাতে এখানকার বসতিদের সুপেয় পানির জন্য লোহার পাইপ, বিদ্যুতের লাইন টানার জন্য বিশাল বিশাল থাম স্থাপন করা হয়েছে। আর এগুলো কখনও গিরিখাদের উপর দিয়ে কখনও পাহাড় ফুরে, কখনও রাস্তা বা এক পাহাড় থেকে অপর এক বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের উপর দিয়ে গেছে। যা খুবই ব্যায় বহুল এবং কষ্টসাধ্য বলে মনে হয়েছে।

ছবির মাঝখানে সরুমতন লম্বা সাদা পাহাড়ি নদী


পিচঢালা পথটা বেয়ে মাইল পাঁচেক চলে সময় যাওয়ার পর ইতিমধ্যেই সূর্যের তাপও মৃদু থেকে বেড়েছে, টানা হাঁটার ফলে আমাদের শারীরিক টেম্পারেচারও ইতিমধ্যে বেড়েছে। সামনেই একটা ছোট মোড়, এই মোড় থেকে আবার দু’টো রাস্তা, একটা উপর দিকে আরেকটা নিচের দিকে গেছে। মোড়ের দোকান থেকে চা আর কেক খেয়ে, দোকানে অবস্থানরত মানুষদের থেকে আমরা জাতিঙ্গা যাওয়ার পথ, আর কতদূর এইসব টুকিটাকি তথ্য নিয়ে নিই। আমরা এতোটা পথ হেঁটে এসেছি জেনে তারা বিস্ময় প্রকাশ করে। এখানে বেশ কয়েকটা অটো দাঁড়িয়ে আছে দেখে বুঝতে পারি এখান থেকে অটো পাওয়া যায়। এখানে যে কেকটা আমরা খাই এমন কেক আমরা আঁগরতলা স্টেশনেও খেয়েছিলাম। দু’টো কেক ই আমাদের এখান থেকে যথেষ্ট মজাদার এবং দামও অনেক কম। ২০ রুপি দিয়ে এখানে যে কেক আপনি পাবেন তা এখানে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ টাকা দাম হবে।

দু’টো রাস্তার যে কোনোটিতেই আপনি জাতিঙ্গা পৌছতে পারবেন। আমরা উপরেরটি বেছে নিয়েছিলাম এবং পড়ে বুঝেছি আমাদের সিলেকশন পারফেক্ট ছিলো। নিচের রাস্তা ধরে অটো চলাচল করে, ফেরার পথে আমাদের অটো ঐ পথেই ফিরেছিলো। উপরের রাস্তাটি আসলে একটি গ্রামের রাস্তা। ছোট ঐ গ্রামটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ আছে। উপরের দিকে উঠে যাওয়া এই গ্রামের পথটি আবার পাহাড়ের ব্যাস বেয়ে নিচের রাস্তার সাথেই গিয়ে মিশেছে। 

জাতিঙ্গা ভিলেজ




এই গ্রামটির নাম ‘জাতিঙ্গা ভিলেজ’। এই গ্রামের বাড়িগুলো এত গুছানো এবং পরিচ্ছন্ন যা সহজেই আপনার নজরে পড়বে, এমনকি রাস্তাতেও আপনি কোনো ময়লা আবর্জনা পাবেন না। বাড়ির বাউন্ডারিগুলো প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, কোমর সমান জবা গাছের সারি কেটে কিংবা পাতাবাহার দিয়ে তৈরি করা। এছাড়াও বাড়িগুলোর গঠনশৈলি অত্যন্ত রুচীশীলতার পরিচয় বহন করে। 




প্রত্যন্ত অরণ্যে এমন একটি গ্রামে দাঁড়িয়ে আমাদের অবস্থান ক্রিয়া কান্ড নিয়ে আমরা আরেকবার লজ্জিত না হয়ে পারি না। গ্রামের পাহাড়ি পথটা দিয়ে নামার মুহুর্তে অদূরে একটা গির্জা আর সারে সার পাহাড় দেখা যাবে, এমন একটা পথ দিয়ে স্কুল ফেরত কোনো শিশুকে পেয়ে গেলে তাকে আপনার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হতে পারে। কি নির্মল ! কি সৌভাগ্যবান ! আহা ! 

জাতিঙ্গা ভিলেজ

জাতিঙ্গা ভিলেজ থেকে নামতেই যে রাস্তাটি নিচ দিয়ে চলে গিয়েছিলো তাতে এসে আপনি পড়বেন। দু’পাশে দুটো দোকান রেখে আরো অল্প নেমে বাঁকটা ঘুরতেই সামনে ডানপাশে পড়বে লালরঙা হাইস্কুল।

 
হাইস্কুলের পরেই টিলার উপরের ছোট্র হাসপাতালটা পেড়োলেই জাতিঙ্গা বার্ড সেন্টার।
আর একটা বাঁক পেড়িয়ে নামলেই জাতিঙ্গা পয়েন্ট। দু’তলা বার্ড সেন্টারের ব্যালকনিটাও ভিউ পয়েন্ট মাথায় রেখে তৈরি, এখান থেকে জাতিঙ্গা পয়েন্ট এর পাহাড়গুলোকে ভালোভাবে দেখা যায়। বার্ড সেন্টার এর রাস্তা দু’টো, আপনি চাইলে একটা দিয়ে উঠে অপরটা দিয়ে নেমে যেতে পারেন।


 
বার্ড ওয়াচ টাওয়ার

বার্ড সেন্টারটা থেকে নেমে মিনিটখানেক হাঁটলেই জাতিঙ্গা পয়েন্ট, দারুণ এক জায়গা এইটা। দেখেই আপনার থেকে যেতে মন চাইবে।চা-বিস্কিট কিংবা অন্যান্য ছোটখাটো পণ্যের আমাদের গ্রামের মনিহারি দোকানের মতো দুইটা দোকান, কিন্তু যেন আবার আমাদের মতো নয়। দোকান দেখে যেমন ভালো লাগবে, দোকানি দেখেও আপনার মন ভরে যাবে, পাহাড়ি বনফুল যেনো। আমাদের এখানে যেমন পুরুষরা সকালে দোকান খুলে বসে এবং রাতে গুছিয়ে ঘরে ফিরে ওখানে ঠিক উল্টো। ঐ দোকানের বেঞ্চিতে বসলে যে পাহাড়ের ভিউটা দেখা যায়, সেটা আপনি ছবি দেখে বড়জোড় অনুমান করতে পারেন সম্পুর্ন বুঝতে চাইলে ওখানে গিয়েই বুঝতে হবে।


লজ এর টিলা থেকে জাতিঙ্গা পয়েন্ট এর লেফ্ট ভিউ


ওখানে সত্যি সত্যিই থাকতে পারবো, কিংবা থাকবো এমন কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিলো না, দোকানে আলাপ করে জানতে পারি সামনেই দেখা যায় টিলার উপরে একটা একতলা ঘর ওটা একটা লজ এবং এখানকার একমাত্র লজ। 

গিরিন চেটিয়া লজ, জাতিঙ্গা পয়েন্ট


 আমাদের তো আনন্দ আর ধরে না, এমন একটা জায়গায় থাকবো কতদিনের সাধ ছিলো। নিচেই একটা গ্যালারি, ওরা গ্যালারি বলে। গঠন শৈলি অন্য হলেও, কাজের দিক দিয়ে মূলত একটা ব্রীজ এর কাজ ই করে। নিচ দিয়ে শিলচর যাওয়ার একটা চমৎকার রাস্তা হয়েছে। 

গ্যালারি, জাতিঙ্গা পয়েন্ট


এই জাতিঙ্গা পয়েন্ট জায়গাটা পৃথিবী বিখ্যাত। পরিযায়ী পাখীরা এখানে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে দল বেঁধে এসে আত্মহত্যা করে। এর কারণ সম্বন্ধে বহু গবেষণা হয়েছে কিন্তু এখনও তার কারণ জানা সম্ভব হয় নি। আমাদের জার্নিটা অক্টোবরে হলেও সময় কম থাকায় হয়তো আমরা তেমন কিছু দেখতে পাইনি।
টিলার উপরের লজটায় উঠে লজ এর মালিক এর সাথে আলাপ হয়। পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোকের নাম ‘গিরিন চেটিয়া’। এই গিরিন চেটিয়া দারুণ এক চরিত্র। ভদ্রলোক আকৃতিগত ভাবে বাঙালীদের মতো নয় তাই প্রথম আমরা হিন্দিতে শুরু করলেও পরে তাকে বাংলা জানেন কি না! জিজ্ঞেস করাতে জানেন বললে আমরা বাংলাতেই আলাপ করি। এই গিরিন চেটিয়া সম্বন্ধে এক বাক্যে বললে বলতে হয় – ‘হি ইজ এন আর্টিস্ট’।

গিরিন চেটিয়া

মালিক বলতে চে চরিত্রটা আমাদের সামনে চলে আসে তিনি মোটেও তা নন্। তিনি নিজেই এই জায়গাটা গভমেন্ট থেকে লিজ নিয়ে লজ চালাচ্ছেন। তিনি নিজেই হাফলং বাজার থেকে বাজার করে নিয়ে আসেন বিভিন্ন সব্জি আর অতিথিদের চাহিদামত মাছ মাংস। আসলে এটাকে লজ না বলে অতিথিশালা বললেই তাকে সঠিক মর্যাদা দেয়া হয়। ওরা আপনাকে অতিথির মতো আপ্যায়ন করবে।


গিরিন চেটিয়া এখানকার পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে রান্না-বান্না সব কিছুই করে থাকেন দু’জন সহকারীকে সাথে নিয়ে। আর রান্নার ক্ষেত্রে চলে তার নৈমিত্তিক এক্সপিরিমেন্ট। বাহারী স্বাদ আর বাহারী ধরণের রান্নার সে কি বৈচিত্র! তিনি যে বেশ আনন্দের সাথেই এই কাজগুলো করে থাকেন তা তার কাজের আউটপুটে স্পষ্ট। চটপটে হাসিখুশি এই ভদ্রলোক চমৎকার অতিথিপরায়ন। তার  রান্নাবান্না বিশেষ করে আঁচার তৈরির জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে পেয়েছেন বিভিন্ন এওয়ার্ডও।


 
এওয়ার্ড নিউজ


তার সহকর্মীরাও তাকে গুরুজ্ঞান করে। এখানের পানি গরম কালেই বেশ ঠান্ডা, আপনি যে কোনো সময় চাইলেই ওরা আপনাকে গরম পানি দেবে। ওখানে আমাদের দু’টো দিন দারুণ কেটেছিলো। ভবিষ্যতে যদি আবার কখনও যাওয়া হয় ওখানে কমপক্ষে দু তিনটা দিন না কাঁটিয়ে আসলে আমাদের মন তৃপ্ত হবে না। তাছাড়া ওখানকার প্রকৃতি অতুলনীয়।
 
একটাই লজ, ওখানে না কি রুম সাধারণত খালি থাকে না, সৌভাগ্যক্রমে আমরা দু’টো রুম খালি পেয়ে যাই। ভাড়া শহরের চেয়ে কিছুটা কম হলেও তা দুই রুম এ ২০০০ রুপি। আমরা রুম পেয়ে যাওয়ার পর বাকী সদস্যদের শহরের রুম ছেড়ে এখানে চলে আসতে বলি ঘন্টাখানেক পরেই ওরা অটো করে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ এখানে চলে আসে। ওরা আসার সময়টুকু আমরা নিচের গ্যালারিতে ঘুরাঘুরি করি।
১১ টার দিকে আমরা গোসল সেরে পরোটা দিয়ে সকালের নাস্তা সারি। প্ল্যান করি ‘এথনিক ভিলেজ’ থেকে ফিরে দুপুর ৪ টার দিকে দুপুরের খাবার খাওয়ার। সেমতেই গিরিন দা’কে বলে হেঁটে যাবো বলে ঠিক করি। তিন কিলোমিটারের এই পথ হয়তো অটোতে নিমিষেই চলে যাওয়া যেতো কিন্তু ছোট ছোট ঝিড়ি, কমলা বাগান থেকে নিজ হাতে কমলা পেড়ে খাওয়া, পাহাড়ি পথটার পরতগুলোর ভাঁজ খুলতে খুলতে যাওয়াটা হয়তো হতো না। তবে রিজার্ভ গাড়ি না নেয়ার একটা বিপত্তিও আছে, ওখানে আলাদা কোনো গাড়ি পাওয়া যায় না। যাওয়ার পথটা নিচের দিকে সহজে যেতে পারলেও আসার পথটা উপর দিকে হেঁটে আসা বেশ কষ্টদায়ক এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, কাজেই বি কেয়ারফুল। রিজার্ভ গাড়ি ছাড়া ওখানে না যাওয়াটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। অন্যথা করে আমাদের মতো এডভেঞ্চার চাইলে ধরা খেয়ে যেতে পারেন। আমরা অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। আমরা যে মনের জোড় নিয়ে ওখানে গিয়েছিলাম পৌছার পর আমরা আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম। বিপদ হতে পারতো।



এথনিক ভিলেজ এর প্রাচীন বাড়ির ডেম্যু


‘এথনিক ভিলেজ’ মূলত পাহাড়ের ভাঁজে একটা কৃত্রিম পার্ক। ওখানে হাফলং এর আদি ঘর বাড়ির ডেম্যু তৈরি করে রাখা। এছাড়াও রয়েছে বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যাবস্থা। এখানে আমলকি গাছ থেকে আমলকি পেড়ে খেতে পারবেন। ফেরার পথে গাড়ি না পাওয়াটা আমাদের জন্য বেশ বিপদজনক হতে পারতো। গাড়ি পাওয়া যাবে না বুঝে আমরা পরিকল্পনা করি আগত অভিযাত্রীদের কারো গাড়িতে লিফট নেয়ার। সেক্ষেত্রে প্রথমে আমরা মেয়েদের ব্যাবস্থা আগে করার কথা ভাবি এবং তাদের তুলে দিতে পারলে আমরা কষ্ট করে হাঁটাই ধরবো এমনটা ঠিক করি।

এথনিক ভিলেজের শিশুদের প্লে গ্রাউন্ড

সে সময়ে ওখানে আগত গাড়িগুলোর মধ্যে ছিলো গির্জার বাচ্চা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আগত দু’টো পিকাপ, ব্যাক্তিগতভাবে নিয়ে আসা একটা সিএনজি এবং একটা জিপ গাড়ি। বেলা তখন পড়ে গেছে। এমনিতেই পাহাড়ি অঞ্চলে রাত নামে তাড়াতাড়ি আমরা দুটো পিকাপকেই টার্গেট করি। আমাদের এ পরিকল্পনায় শাপে বর হয় গির্জার মিস্ট্রেস এর সাথে পূর্বে নাজনীন এর ছবি তোলা।



এতে তার সাথে আমাদের স্বল্প যে হৃদ্যতা তৈরি হয়, আমরা সে ব্যাপারটাকেই কাজে লাগাই। তাকে ব্যাপারটা বললে তিনি আমাদের সমস্যা বুঝে না করতে পারেন না। তাছাড়া এমনিতেই ভদ্রমহিলাকে ছিলেন বেশ আন্তরিক। প্রথমে তিনজনের কথা বললেও, ভিড় থাকার কারণে নিজেরা সংকোচ বোধ করলেও, গাড়ি ছাড়ার  মূহুর্তে আমরা বাকী তিনজনও ছাত্র-ছাত্রীদের ভীড়ে উঠে পড়ি, চালকের সহকারীও এ ব্যাপারে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। 



এই পিকাপ জার্নিটা আমরা বোধ হয় ভূলতে পারবো না কখনই। দুটো পিকাপ ই গির্জার স্টুডেন্ট এ ঠাঁসা। আমরা সবাই পিছনের পিকাপটাতে একে অপরের শরীরে চেপে দাঁড়িয়ে, পিকাপ খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠা শুরু করলো বাচ্চারা সবাই ভয়ের নয় আনন্দের চিল্লাফাল্লা শুরু করলো, আমরাই বা থেমে থাকবো কেনো ! আমরাও তাদের সাথে যোগ দিলাম। প্রত্যেকেই গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে আনন্দ উল্লাস করতে করতে জাতিঙ্গা পয়েন্ট পৌছলাম। আমাদের এখানকার মাদ্রাসা শিক্ষা আর গির্জার শিক্ষার মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য আমাদের নজর এড়ায়নি। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ছাড়াও তাদের মধ্যে যে জিনিসটা তাদের মধ্যে দৃশ্যমান তা হচ্ছে ছেলেমেয়েরা বেশ একটা উমুক্ত আনন্দ ঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। আমাদের সাথে ওদের বেশ ভাব বিনিময় হলো, ওরা বেশ স্মার্টলি সবার সাথে ছবি তুললো, নিমেষেই আপন করে নেয়ার মতন হৃদ্যতার উপস্থিতি তাদের মধ্যে লক্ষ করা গেলো। পৌছার পর আমরা তাদের কাছ থেকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম। হাস্যোজ্জল দূরন্ত কিশোর কিশোরিরা আমাদেরকে হেসে বিদায় জানালো। আমরা যদি নিজেদের ভাড়া গাড়ি নিয়ে ওখানে যেতাম এই আনন্দটার অংশ কিছুতেই হতে পারতাম না। কোনো নতুন অজানা জায়গায় গিয়ে পরিকল্পনার অভাবও এভাবেই আমাদের নতুন কোনো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার পুঁজি হয়ে উঠতে পারে।
পড়ন্ত বিকালে রুমে ফিরে আমরা ফ্রেশ হতে হতেই দেখি হোটেলের লনে খোলা আকাশের নিচে টেবিল পেতে আমাদের দুপুরের খাবার দেয়া হয়ে গেছে। টিলার উপরের এক তলা এই লজটার সামনের নানা ফুলের গাছ বেষ্ঠিত যে অল্প লন বা উঠোনের মতো জায়গা ওখান থেকে পাহাড় সারিগুলোকে সামনে রেখে খোলা আকাশের নিচে বসে সুস্বাধু কোনে খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা আপনার পিছু ছাড়বে না যতদিন বেঁচে থাকবেন। ছেড়ে আসার কথা মনে হলেই মনটা হু হু করে উঠবে।



সন্ধ্যার আগে আগে আপনি এই লজের নিচে অবস্থিত টং দোকানগুলোতে গিয়ে চা খেতে খেতে সকলে মিলে আড্ডায় বসতে পারেন। দোকান থেকে পাহাড়ের যে চূড়ার অংশটা দেখা যায়, দেখবেন কুয়াশা চূড়াটায় ঝেঁকে বসে রাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মৃদু ঠান্ডা বাতাস কো থেকে এসে যেনো আপনার মনের তৃণকে নাড়িয়ে দিতে থাকবে থেকে থেকে। আপনি এখানকার সবে দুইদিন এর অতিথি এই ব্যাথাবোধ আপনার ভেতর মোচর দিয়ে উঠবে।


পরের দিন ঘুম থেকে উঠে সকাল দেখতে বেরুতে পারেন। দোকান থেকে চা নাস্তা সেরে নিচের গ্যালারি পথে নেমে হেঁটে পাঁচ মিনিটের পথ অতিক্রম করে চলে যেতে পারেন কাছেই পাহাড়ি পাথুরে জাতিঙ্গা নদীতে। ওখানে পরিষ্কার হিমশীতল জলে স্নান সেরে আসতে পারেন। ওখানে আপনার ঘন্টাখানেক সময় কোথা দিয়ে চলে যাবে টের ই পাবেন না। 

জাতিঙ্গা নদী (উপর থেকে)


 আমাদের ছিলো ফেরার দিন। নিউ হাফলং স্টেশন থেকে আমাদের ট্রেন ধরতে হবে ১২ টায়। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো নদী থেকে ফিরে নাস্তা সেরে ট্রেন আসার ঘন্টাখানেক পূর্বে যেনো স্টেশনে পৌছতে পারি। স্টেশনটাতে আমাদের ঘন্টাখানেক সময় কাঁটানোর বেশ ইচ্ছে ছিলো। সে মতেই আমরা ৯ টার দিকে নদী থেকে ফিরে নাস্তা সেরে গিরিণ দা’র মাধ্যমে ফোন করিয়ে একটা অটো আনিয়ে খাবার টাকা আর রুমের ভাড়া পরিশোধ করে, ১০:৪০ এর দিকে অটোতে চড়ে সর্পিলাকার পাহাড়ি পথটা বেয়ে বেয়ে এবার নিচের দিকে নামতে থাকলাম, ১১:১০ এর দিকে স্টেশনে পৌছে গেলাম। গাড়িতে উঠার আগে যখন আমরা গিরিণ দা’র সহকারীকে কিছু টিপস্ দেয়া উচিত ভেবে দিতে চাইলাম তখন আমরা আরেক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। তাদের ব্যাক্তিত্বে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। তারা টিপস্ নেয়ার বিষয়ে তাদের অসম্মতিতে অনড়, পরে গিরিণ দা বলার পরে তারা তা নিলো। বিদায় এর আগে কুকিং আর্টিস্ট গিরিন চেটিয়ার সাথে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই ছবি তুললাম। 
স্টেশন চত্বরে ঘুরে ফিরে দেখার জন্য আমরা যে সময়টুকু হাতে নিয়ে এসেছিলাম আমরা তা কাজে লাগালাম। যথা সময়ে আমাদের ট্রেন পৌছলো, এবার আর ভিন্ন বগি নয়, আমাদের টিকিট আগেই কাঁটা ছিলো, একই বগিতে সকলেই পাশাপাশি চড়ে বসে, ছেড়ে আসার মন খারাপ একটা অনুভূতি নিয়ে দীর্ঘ ৮ ঘন্টার জার্নি শেষে সন্ধ্যা ৮ টায় আমরা পৌছে গেলাম আঁগরতলা স্টেশন। দূর্গাপূজার আলোকজ্জল আঁগরতলার রাতের রাস্তা দিয়ে অটো করে পূর্বেই এইদিনের রুম বুকিং দিয়ে যাওয়া হোটেলে রাত্রি যাপন। পরেরদিন সকালের নাস্তা সেরে সকাল ৯ টার দিকে ইমিগ্রেশন ফেস করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আখাউড়া স্টেশনে পৌছতে পৌছতে ১০:৩০। ফেরার ট্রেনের বিজয় এক্সপ্রেস এর টিকিট করা ছিলো আমাদের, ট্রেন ১১:৩০ এ আখাউড়া আসে, নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন স্টেশনে আসলে আমরা তাতে চেপে ৪ টার মধ্যে ময়মনসিংহে পৌছে গেলাম। বুকে করে নিয়ে এলাম দারুণ এক জনপদের ছবি। যদি আবার কোনোদিন সময় সুযোগ মেলে হয়তো আরো একবার ছুটে যাবো ফেলে আসা পৃথিবীর সেই বিষন্ন স্টেশনে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সোনাদিয়া : আ ডিজার্টেড আইল্যান্ড

 সময়কাল ২০২৪।  কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর জনাকীর্ন তিনটি পয়েন্ট ডলফিন মোড় থেকে শুরু। প্রথমটি কলাতলী শেষেরটি লাবণী আর মাঝের পয়েন্টটির নাম সুগন্...