বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সোনাদিয়া : আ ডিজার্টেড আইল্যান্ড

 সময়কাল ২০২৪। 

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর জনাকীর্ন তিনটি পয়েন্ট ডলফিন মোড় থেকে শুরু। প্রথমটি কলাতলী শেষেরটি লাবণী আর মাঝের পয়েন্টটির নাম সুগন্ধা। সাধারণত এই তিনটি সৈকতই মানুষের গন্তব্য থাকে। এছাড়া এখান থেকে মানুষের গন্তব্য থাকে ৯০ কিমি দূরুত্বের সেন্টমার্টিন ২০ কিমি দূরের মহেশখালি ইত্যাদি জায়গা। এই তিনটি পয়েন্ট থেকে উত্তর পশ্চিশে তাকালে যে বৃক্ষের ঘনকালো ছায়ার মতো চোখে পড়ে তা ই সোনাদিয়া।



 খুব কম সংখ্যক মানুষ ই হয়তো এই দ্বীপটির সন্ধান জানেন। সেই কারণ ই হয়তো এখনও এই দ্বীপটিকে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে সহায়তা করেছে।



কক্সবাজার থেকে এতো কাছে এতো চমৎকার একটি জায়গার এই প্রাকৃতিক অবয়ব কতদিন থাকবে জানিনা। ইতিমধ্যেই এখানে বিদ্যুত এর লাইন হয়ে গেছে , এই লাইন দিয়ে আসবে বিদ্যুৎ, এর পিছু পিছু আসবে ব্যাবসায়ী আর তার হাত ধরে ব্যাবসা, আর সেটিই কাল হবে এই দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও। এর মধ্যে যারা এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সান্যিধ্য পাবে তারা সৌভাগ্যবান। নির্ঝনতা এখানে নিবিড়।



এখন পর্যন্ত ৬-৭  হাজার মানুষ এই দ্বীপটিতে বাস করেন। ঝাউবন কেওড়া বনে ঘেড়া এই দ্বীপটিতে পাকা বাড়ি এখন পর্যন্ত হাতেগোনা দু’একটি। ইট, বালু, সিমেন্ট, রড সব নিতে হয় মহেশখালি থেকে। সোনাদিয়া মহেশখালি উপজেলার অন্তর্ভূক্ত। এর উত্তরে মহেশখালি, পূবে কক্সবাজার, দক্ষিণে এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। পূর্ব পাড়া এবং পশ্চিম পাড়া এই দুটি ভাগে সাধারণত দ্বীপটি বিভক্ত, সে অনুসারেই এর ডাকনাম। আয়তনে দ্বীপটি ৯ কিমি মতন হলেও নতুন নতুন ভূমি তার সাথে যোগ হচ্ছে ধীরে ধীরে।



 দ্বীপে যাওয়ার সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ কক্সবাজার থেকে অটোতে ৫-৬ কিমি দূরের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শুটকি পল্লী নাজিরাটেক হয়ে।



নাজিরাটেক এর মানুষের প্রধান ব্যস্ততা  মাছধরা মাছ বিক্রি, শুটকি উৎপাদন শুটকি বিক্রি কেন্দ্রিক।

নাজিরাটেক সৈকত

বঙ্গোপসাগরের এই মোহনা থেকে বেড়িয়েছে বাঁকখালি নদী। এই বাঁকখালি নদী দিয়েই ৬ নং ঘাট থেকে মহেশখালি-কক্সবাজার যাওয়া আসা করে দৈনিক হাজারো মানুষ। নাজিরাটেক এই বাঁকখালি পারেই কক্সবাজার বিমানবন্দর। এখানেই বিমান উড়োজাহাজ ল্যান্ডিং এর জন্য বাঁকখালির উপরেই নির্মাণ হচ্ছে রানওয়ে।

নাজিরাটেক সৈকতে মাছ ধরার বোট


নাজিরাটেক থেকে ছোট কমলা রঙের বোটে ১৫-২০ মিনিটে সোনাদিয়ার পূর্ব পাড়া। এখানে সুন্দর ছোট একটি পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট করা হয়েছে। পশ্চিম পাড়াতেও রয়েছে একটি রিসোর্ট।



পশ্চিম পাড়ার বিচ সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু তাতে যেতে হলে কষ্ট করে যেতে হবে। এই দ্বীপের রাস্তা বলতে হাঁটা পথ। কোন অটো রিক্সা বা কোন বাহন নেই। পশ্চিম পাড়া থেকে পূর্বপাড়া কিংবা পূর্ব পাড়া যেতে হয় ২ থেকে ৩ ঘন্টা  হেঁটে।  

পশ্চিম পাড়া সৈকত

কক্সবাজার এর ৬নং ঘাট থেকে ট্রলার বা স্পিডবোটে মহেশখালি, সেখান থেকে অটোতে ঘটিভাঙা ঘাট, যা প্রায় ১০-১২ কিমি পথ পেড়িয়ে। ঘটিভাঙা ঘাট থেকে বোটে মিনিট ৪০ এর পথ পেরিয়ে সোনাদিয়ার পশ্চিমপাড়া। সেক্ষেত্রেও আছে বিড়ম্বনা । সারাদিনে কেবল একটি বোট জোয়ারের সময় ১০-১১ টার মধ্যে। না পেলে নাই। রিজার্ভের ক্ষেত্রে ফোন নাম্বার থাকলে হয়তো ব্যবস্থা করা সম্ভব।

ঘটিভাঙ্গা ঘাটের কমলারঙের বোট


পূর্ব পাড়া দিয়ে দ্বীপে প্রবেশে নাজিরাটেক হয়ে গুনতে হবে ৮০০শ থেকে ১০০০  টাকা, এক কিংবা দশ যাত্রী যাই হোক। পশ্চিম পাড়া দিয়েও রিজার্ভে একই, তবে লোকালে জনপ্রতি ৫০ টাকা।

লোকাল বোট যাত্রী

পশ্চিম পাড়া নৌপথটি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের মতো, যত্রতত্র শাঁসমূলও দেখা যায়। ছোট বড় নানা ধরণের পাখীদের সাথে এই পথেই আমি প্রথম সারস দেখেছিলাম। নানা উপায়ে মাছ ধরার আয়োজন এই পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

পশ্চিম পাড়ার নৌপথ


 আমরা পশ্চিম পাড়া দিয়ে প্রবেশ করে বিচ দিয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা হেঁটে পূর্ব পাড়ায় পৌছেছিলাম। বিচ ঘেষা দীর্ঘ ঝাউবনের সারি। কৃত্রিমভাবেই এই বন তৈরি হলেও তা এখন প্রকৃতির অংশ। 


সোনাদিয়ার পশ্চিম পাড়া ঘাট


নির্জন এই দ্বীপটির কৃষি এবং সাগরে মাছ ধরা  বেশির ভাগ মানুষের জীবিকার উৎস। এছাড়াও বোট চালনো, দুয়েকটি ছোট দোকান, গরু-মহিষ পালন ইত্যাদি পেশার সাথে মানুষ জড়িত। খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে চাল মাছ মাংস ডিম দুধ  নিজেরাই উৎপাদন করেন। বাড়তি অংশ কক্সবাজার কিংবা মহেশখালিতে বিক্রি করেন। কাপড় কিংবা অন্যান্য নিত্যপণ্য তারা মহেশখালি কিংবা কক্সবাজার থেকে যোগাড় করেন। পূ্র্বে কেউ কেউ জলদস্যুতার সাথে জড়িত থাকলেও  এখন আর তা নেই। টিউবয়েলে এখানে মিঠাপানি আসে।



এই দ্বীপটিতে একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই দ্বীপের অভিবাসীদের সন্তানদের লেখাপড়া বলতে ঐ প্রাথমিক পর্যন্তই। প্রাথমিক শেষ করে তাদের মহেশখালি কিংবা কক্সবাজারে পাঠানো হয়না উপর্জনের জন্যই। তারা পরবর্তীতে মাছধরা কাঁকড়া ধরা ইত্যাদি পেশার সাথে জড়িত হয়ে যান। চিকিৎসার জন্য এখানে কোন হাসপাতাল বা কমিউনিটি সেন্টার নেই। সপ্তাহে ১-২দিন প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তার অনিয়মিতভাবে আসা যাওয়া করেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ই সবাই। দুইটি মসজিদ আছে এখন পর্যন্ত। ভূমির কোন ব্যক্তিগত মালিকানা এখানে নেই। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বলতে বেশিরভাগ মানুষ ই দ্বীপের দুয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের কথামতই ভোট কার্যক্রমে তাদের সমর্থন প্রদান  করেন।

ঝাউবনের ভিতর পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় পাড়ার দুইটি রিসোর্টে মাচা করে চালাঘর কিংবা তাবু করে থাকা রাত্রীযাপন এবং খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ১৫০০ টাকার বিনিময়ে। 



নারী-পুরুষ সকলের জন্যই দ্বীপটি নিরাপদ। ক্যাম্প করে বার্বিকিউ করার ব্যবস্থা রিসোর্ট এর লোকেরাই করে দেন। পূর্বপাড়া থেকে নাজিরাটেক হয়ে কক্সবাজার ফেরার বোটও তারা যেকোন সময় ব্যবস্থা করে দেন।

সকালে বের হয়ে মহেশখালি ঘুরে ১০-১১ টার মধ্যে ঘটিভাঙা থেকে পশ্চিমপাড়া হয়ে পায়ে হেঁটে পূর্বপাড়া দিয়ে কক্সবাজার ফেরত আসা কষ্টকর হলেও এটাই এই দ্বীপকে দেখার সর্বোত্তম পন্থা। 

বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০২৩

তুরা (গারো পাহাড়) ; মেঘালয়

আবেশন

আসাম থেকে ১৯৭১ এ আলাদা হয়ে নতুন রাজ্য হয় মেঘালয়। এ রাজ্যের গারো হিল্স, খাসি হিল্স, জৈন্তা হিল্স এর মধ্যে গারো হিল্স এর অবস্থান মেঘালয় এর পশ্চিমে। এ রাজ্যের রাজধানী শিলং গারো হিল থেকে ৩১০ কিমি; ৮ ঘন্টার পথ, যা খাসি হিল এ অবস্থিত।  সাধারণত মেঘালয়ের ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন বলতে সৌখিন ট্যুরিস্টরা খাসি হিলকেই বুঝেন। আসলে মেঘালয় পুরোটাই অপেক্ষাকৃত দূর্গম আকর্ষণীয় একটি পাহাড়ি জনপদ। নানা ট্রাইবাল ননট্রাইবাল, উদ্ভিদ, প্রাণী মিলেমেশে এখানে সহাবস্থান করে। ঝর্ণা, পাহাড়ি পাথুরে নদীর ছড়াছড়ি সারা মেঘালয় জুড়েই। এর দক্ষিণে বাংলাদেশ এর ময়মনসিংহ সিলেট, পূর্ব  এবং উত্তরে আসাম, পশ্চিমে একাংশে বাংলাদেশ আরেক অংশে আসাম।





ময়মনসিংহ শহর থেকে নাকুগাঁও পর্যন্ত মোট ৭৬ কিমি পথ। বাস সি.এন.জি তে নালিতাবাড়ি পর্যন্ত  ৬৩ কিমি পথ গিয়ে অবশিষ্ঠ ১৩ কিমি পথ অটো রিক্সা, সি.এন.জি কিংবা ভাড়া মোটর বাইকে সহজেই পৌছে যাওয়া যায় নাকুগাঁ স্থলবন্দরে। এই বন্দরটি দিয়ে পাথর ভর্তি ট্রাক মেঘালয় আসাম থেকে আসা যাওয়া করে। বহু শ্রমিকের কর্মস্থল এই স্থলবন্দরটি।




এই বন্দরের বাংলাদেশ অংশের নাম নাকুগাঁও এবং ভারতীয় পোর্ট এর নাম ঢালু। ঢালু পোর্ট দিয়ে ভিসা করে নাকুগাঁঁও অংশে ইমিগ্রেশন, কাস্টম্স অফিসে ট্রাভেল ট্যাক্স ১১০০ টাকা দিয়ে,  এবং বিজিবি চেক এর পর ( ইমিগ্রেশন, কাস্টম্স এবং বিজিবি ৩ টি পয়েন্টেই নাম এন্ট্রি করবে) , ঢালু অংশে একই প্রসেস সারতে হবে। 



এই পোর্টে ভীর সবসময় ই অন্য পোর্ট এর থেকে কম হলেও উভয় পয়েন্ট এর কাজ সারতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। ঢালু অংশে ইমিগ্রেশন অফিস কাস্টমস অফিস থেকে ১ কিলোমিটার এর মতো দূরে।  না হেঁটে একটা অটো নিয়ে কাস্টমস এর কাজ শেষ করে ইমিগ্রেশন অফিস যাওয়াই ভালো। তবে এখানে কাস্টম্স অফিস থেকে ইমিগ্রেশন অফিস পর্যন্ত যাওয়ার সময় কোন বাহন না পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। 

ঢালু ইমিগ্রেশন অফিস

বৈঠকখানার মতো একটা ঘরে এখানে ইমিগ্রেশন অফিস হেল্পফুল। দিনে ৩০-৪০ জন যাত্রী এ পথে আসা যাওয়া করে, সেকারণেই হয়তো ইমিগ্রেশন অফিস আধুনিকায়ন এর কোন পরিকল্পনা নেয়া হয় না। ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের জন্য এ পথে সেভেন সিস্টারের বিশেষ করে মেঘালয়, আসাম, অরুণাচল এমনকি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব অংশে (শিলিগুড়ি, কুচবিহার, সিকিম, দার্জিলিং) যাওয়া অপেক্ষাকৃত উত্তম সহজ পথ (ত্রিপুরা বাদে)।

মানি এক্সচেঞ্জ

এখানে বাংলাদেশ কিংবা ভারত কোন অংশেই মানি এক্সচেঞ্জ নেই। পোর্ট সংলগ্ন এলাকার বাংলাদেশ অংশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা টু রুপি একচেঞ্জ করা যায়। ঢালুতে গিয়ে করতে চাইলে বিরম্বনা হতে পারে, তাছাড়া রেটও কম পাওয়া যায়। ঢালু ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বারেঙ্গাপাড়া বাজার ৪ কিমি পথ, সেখানেও করা যাবে। 




তবে হুন্ডি থেকে ময়মনসিংহ শহরে অপেক্ষাকৃত রেট বেশি থাকে। লিগ্যাল প্রসেস হিসাবে ডলার নিয়ে গেলে তবে তুরায় পৌছে কেবল ব্যাংক থেকে ডলার টু রুপি এক্সচেঞ্জ করা যাবে। এখানে বারেঙ্গাপাড়া কিংবা তুরা কিংবা ইমিগ্রেশন অফিসের সামনে কোথাও মানি এক্সচেঞ্জ নেই। ডুয়েল কারেন্সি কার্ড দিয়ে বুথ থেকে এক্সচেঞ্জ করা যেতে পারে। অন্য পোর্ট এর মতো এখানে মানি হেন্ডলিং এর ব্যাপারটা আমার কাছে ততটা জটিল মনে হয় নি। রুপি নিয়ে গেলেও সমস্যা হয় না। তবে কি কি কারেন্সি আছে তা বিএসএফ জিজ্ঞেস করে এন্ট্রি করবে আসা এবং যাওয়া উভয় সময়েই। তবে যাই ই থাকুক কম করে বলাটাই বোধহয় উত্তম। 

 তুরা’র পথে

গারো বিশ্বাস মতে, পাওয়ারফুল গড ‘ডুরামা আম্বামা’র নাম অনুসারে এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ পাহাড় সারির নাম ‘ডুরা আগ্রি’ বা ডুরা হিল ডাকা হতো। ব্রিটিশরা পরবর্তীতে একে ‘তুরা’ নামে সম্বোধন করতো। বর্তমানে সকলেই একে ‘তুরা’ নামে ডেকে থাকে।

ইমিগ্রেশন অফিসের সামনে থেকে ২০ রুপিতে অটোতে করে বারেঙ্গাপাড়া বাজার। সেখান থেকে তুরায় পৌছার একাধিক প্রকারের বাহন আছে- উইঞ্জার (বড় মাইক্রো বা হায়েজ জাতীয় ১৩ সিটের গাড়ি) যাার ভাড়া ১৫০ রুপি সময় লাগে ১ ঘন্টা ১০ মিনিট। অপরটি হচ্ছে বাস; ভাড়া ১৫০ রুপি, এছাড়া অটো সি.এন.জি জাতীয় গাড়িতেও যাওয়া যায়। আমি প্রথমবার বাস এবং দ্বিতীয়বার যাওয়ার সময় উইঞ্জারে গিয়েছিলাম। উইঞ্জার বেস্ট অপশন।

ঢালু থেকে গাড়ি যাওয়ার সময় শুধু উঠবে আর আসার সময় শুধু নামবে। বিকাল ৩:৩০ এ শেষ বাস। ঘন্টাখানেক পর পর বাস পাওয়া যায়। এই পথে যে পাহাড়টা দৃষ্টিসীমায় সব পাহাড়ের সবচেয়ে উপরে থাকে সেটিই ‘তুরা পিক’ নামে পরিচিত। 

তুরা পিক

যেতে যেতে তুরা পিক এর ঠিক চূড়ার কাছাকাছি তুরা বাজার বা তুরার গোটা শহর। বারেঙ্গাপাড়া থেকে ২-৩ কিমি এর সমতল পথ পাড়ি দিতেই পাহাড় বেয়ে বাস উঠে যাবে উপরের দিকে। পথে পড়বে ছোট ছোট আঞ্চলিক বাজার, স্কুল, মন্দির, ট্র্যাডিশনাল গারো বাড়ি ঘরের পিছনে পাহাড়ের ব্যাকড্রপ ইত্যাদি। তুরা বাসস্ট্যান্ড পাহাড়ের উপরে হলেও তুরা বাজার থেকে ডাউন হিল এ অবস্থিত। শহর এর সেন্ট্রাল পয়েন্ট তুরা বাজার। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা একাই এসব বাসে যাতায়াত করে। নিরাপত্তাহীনতা এখানে অপরিচিত শব্দ বলেই মনে হয়েছে।

তুরা বাসস্ট্যান্ড

যাওয়ার পথে বাস তুরা বাজার বা সুপার মার্কেটকে বামপাশে রেখে যাত্রী নামিয়ে ডিসি হিল এ উঠে ডান দিকে নেমে যায় বাসস্ট্যান্ডে । কিন্তু আসার পথে তুরা বাজার থেকে ১০ রুপি ভাড়ায় অটোতে বাসস্ট্যান্ড এ এসে টিকিট নিয়ে বাসে উঠতে হয়। আর উইঞ্জার ঢালু থেকে আসামের কৃষ্ণা পর্যন্ত চলে। উইঞ্জার তুরা সুপার মার্কেট এর সামনে যাত্রী নামিয়ে আপার হিল ধরে রংরাম, আসানাং হয়ে সোজা চলে যায় কৃষ্ণা পর্যন্ত। কৃষ্ণা যেতে সময় লাগে ৪ ঘন্টা ভাড়া ৪৫০ রুপি। উইঞ্জারে করে গুহাটি যাওয়া বাসের থেকে সহজ এবং সময় সাশ্রয়ী। গুহাটিগামী বাস সকাল ৬ টায় এবং রাত আটটায় যা আমাদের জন্য ঝামেলাকর। ঢালু থেকে সরাসরি কৃষ্ণা, সেখান থেকে ১৫০ রুপিতে ২ ঘন্টায় গুহাটি। কৃষ্ণাতে ট্রেন স্টেশন আছে সেখান থেকে কেউ চাইলে অটোতে ৩০ রুপিতে স্টেশনে পৌছে ১ ঘন্টায় গুহাটি পৌছতে পারেন।

হোটেল

সুপার মার্কেটটি এভারেজ মানের একটি মার্কেট হলেও এখানকার প্রধান মার্কেট এবং কেন্দ্রস্থল। এর চারপাশে সব্জী বাজার। বর্তমানে ডাউন হিলে বাস স্ট্যান্ড এর দিকে ইন্ডিয়া বাজার নামে একটি আধুনিক সুপার শপ হয়েছে। তুরা সুপার মার্কেট এর চারপাশের রাস্তার ডান পাশের রাস্তার মোড়ে সানদারে হোটেল (এখানে ভাড়া ডাবল বেড নন এসি ২২৪০ রুপি সকালের নাস্তা মেন্ডেটরি, লাক্সারি ব্রেকফাস্ট ইনক্লডেট)। রেস্টুরেন্ট তৃতীয় তলায় এবং হোটেলে ক্রেডিট কার্ড একসেপ্টেবল, ওয়াই-ফাই এভেইলেভল।




 সুপার মার্কেট এর সামনের রাস্তার ডানের মোড়ে হোটেল রিকম্যান (নন এসি ডাবল বেড ভাড়া ২৮০০ রুপি)। দুইটি হোটেল এর মান ভালো। 

হোটেল রিকম্যান



বাম পাশের মোড়ে হোটেল প্যারামাউন্ট এটির মান ততটা ভালো নয়, রেট ১৫০০ টাকার মতো। এই হোটেল এর আন্ডারগ্রাউন্ডে আরো ৩টি ফ্লোর রয়েছে। 

হোটেল প্যারামাউন্ট


 বাংলাদেশীরা এখানে মোবাইল সীম পাবেন না। শহর থেকে ২ কিমি দূরে হোটেল পলো অর্কিড সবচেয়ে ভালো, খোলামেলা এবং ওয়াফাই সম্বলিত। সকালের মেন্ডেটরি নাস্তা সহ এই হোটেল এর ভাড়া ২৮০০-৩০০০ রুপি। ফ্যামিলি নিয়ে এটা বেস্ট। এটি হাওয়াখানা পার হয়ে কেন্দ্রস্থল সুপার মার্কেট থেকে প্রায় ২.৫ কিমি দূরে।

পলো অর্কিড

এছাড়া শহরে আর যে ৩ টি হোটেল আছে সেগুলোতে ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট এলাউ নয়। হোম স্টে আছে শহরের বাইরে ওগুলো ভালো ।

জনজীবন

শহরটি তুরা পাহাড়ের উপরে নিচে মিলিয়ে গড়ে উঠেছে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নানা নন ট্রাইবালদের মধ্যে রয়েছে বাঙালী, বিহারী, নেপালি সহ কম বেশি নানা জাতীসত্বার মানুষ। ট্রাইবালদের মধ্যে গারো, হাজং, খাসি ।


উপরে তুরা পিক


 বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সম্মিলন এখানে। সংখ্যাগত দিক থেকে সকল নন-ট্রাইবালদের সম্মিলিত পরিমাণ ট্রাইবালদের প্রায় সমানে সমান। তবে নন-ট্রাইবালরা এখানে রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত বলা যায়, নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে না। এ নিয়ে নন ট্রাইবালদের মধ্যে ক্ষোভ আছে এমন মনে হয়নি। নূন্যতম মুজুরি এখানে ১৫-২০ হাজার টাকার মধ্যে। যত্রতত্র প্রভাব চর্চা এখানে হয় না। মানুষ যথেষ্ঠ সুখী। যে সমস্ত বাঙালীদের সাথে কথা বলেছি তাদের প্রত্যেকের ই পূর্ব পুরুষ কোন না কোন সময় বাংলাদেশে ছিলেন বলে জেনেছি। উচ্চতর শিক্ষার জন্য তার শিলং কিংবা অন্য প্রদেশেও গমণ করেন, তেমনি উচ্চতর চিকিৎসার জন্যও তারা অন্য রাজ্যমুখী হন। হিন্দি সকলেই বুঝেন, বিভিন্ন ভাষাভাষির সাথে হিন্দিতেই ভাব চালাচালি করেন। বাঙালী পাড়া, বাঙালী স্কুল, গুর্খা স্কুল রয়েছে। সিনেমা হল নেই। নাট্যশালা, গানের দল রয়েছে। বহিরাগতদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র আছে বলে সন্ধান পাই নি। তুরা বাজার এলাকা পুরাতন, মধ্য এবং উচ্চবিত্তরা আপার হিলে নতুন নতুন স্থাপনা করেছেন। ডন বস্কো সহ ট্রাইবাল স্কুল কলেজ আপার হিলেই অবস্থিত। তুরা টিভি স্টেশনও আপার হিলে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা শহরের কাছাকাছি ই অবস্থিত।

বিহারি

তুরা বাজারের আশপাশে বিহারিরা দৃশ্যমান। বিহারিরা বিহার থেকে বংশ পরম্পরায় এখানে মালামাল লোড-আনলোড এর কাজ করে থাকে। বিহারিদের পরিবার বিহারে থাকেন, পুরুষরা যারা আসেন তারা সাধারণত একসঙ্গেই অবস্থান করেন।

গারোদের পারিবারিক ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। পাহাড়ি এই দূর্গম অঞ্চলটির প্রগতিশীলতা পূর্বে দেখা ভারতের অন্য অঞ্চল থেকেও অনেক বেশি। নারী পুরষের কোন ভেদ বা ফারাক নেই। খাদ্য দ্রব্য এবং অন্যান্য বহু সুবিদার জন্য তাদের বহিরাজ্যের শরনাপন্ন হতে হয়। তাই বিভিন্ন পন্য এবং সুবিধার জন্য এখানে অন্য রাজ্য থেকে বেশি মূল্য গুনতে হয়; কোথাও দ্বিগুন এর ও বেশি। সে হোক খাদ্যদ্রব্য কিংবা হোটেল সার্ভিস কিংবা যানবাহন। 

শহর

তুরা বাজার

লাল হলুদ বিল্ডংটিই তুরা সুপার মার্কেট এর পশ্চাৎভাগ এবং এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে নীলাভ অংশটিই তুরার কাঁচা বাজার। এই রাস্তাটির উপরের মোড়টি সানদারে হোটেল এর মোড় লোকেরা একে সুন্দরী হোটেল বলে।  উঁকি দেয়া পাহাড়টিই তুরা পিক। চূড়ার খুব কাছাকাছি হলেও শহর থেকে তুরা পিক এ উঠতে ৩ ঘন্টা, নামতে তার অর্ধেক সময়।


সুপার মার্কেট এর সম্মুখভাগ

৩ তলা বিশিষ্ঠ  তুরা সুপার মার্কেটটি অন্য সুপার মার্কেটে প্রাপ্য পণ্যের প্রাচুর্য কিংবা পরিধিতে ছোট হলেও তুরাতে এটিই সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস। আকর্ষণীয় কিংবা বিশেষ পণ্যের মার্কেট না হলেও এখানে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মুদি, কনফেকশনারি কিংবা বেকারি পণ্য একপাশে অপর পাশে ইলেকট্রনিক্স পণ্য। দু’তলায় খেলনা, ব্যাগ ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় কাপড়। তবে বাংলাদেশীদের জন্য এসব এদেশ থেকে তুলনামূলক বেশি দাম ই বলা যায়। তবে কিছু কেনাকাটা করতে চাইলে এখান থেকেই করতে হবে।

তুরা সুপার মার্কেট (অভ্যন্তরভাগ)


সুপার মার্কেট সামনের ছোট রাস্তাটিতেই বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ার বিভিন্ন সার্ভিস এর কাউন্টার, আর সামনে পিছনে সহ দু’পাশের ফুটপাতে সব্জী বা পাহাড়ি ফলমূল এর বাজার। পশ্চিম পাশে দুটো বাঙালী খাবার হোটেল আর সান্ধ্যকালীন স্ট্রিটফুড এর দোকান। রিকম্যান হোটেল এর সেকেন্ড ফ্লোরে ভিতরে একটি বাঙালী খাবার হোটেল রয়েছে।

এখান থেকে শিলং, শিলিগুড়ি, গুহাটি যাওয়ার বাস, সুমো জিপ, জাইলো নামে বড় মাইক্রোবাস সদৃশ একধরণের সার্ভিস চলাচল করে। অধিকাংশ সার্ভিস ই রাত ৮ টা থেকে। তবে সকালেও আছে। তুরা থেকে বাসে শিলং ৭-৮ ঘন্টা, গুহাটি ৬ ঘন্টা, শিলিগুড়ি ৮-১০ ঘন্টা সময় লাগে। ভাড়া ৬০০-৮০০ রুপির মধ্যে। শিলিগুড়ি রিজার্ভ জাইলো ১৫-১৭ হাজার টাকাঅ এছাড়া এখান থেকে হেলিকপ্টার সার্ভিস যোগে ৩০ মিনিটে শিলং গুহাটি পৌছা যায়। 


কাউন্টার 

সুপার মার্কেট এর ডানপাশের মোড় থেকে অপেক্ষাকৃত খাড়া উপরের দিকে পথটির অপর মাথায় ডিসি হিল। এই হিলে ডিসি অফিস অবস্থিত বলে একে ডিসি হিল বলে। এখানেই ব্যাংক কিংবা বুথ আছে। ছোট ডিসি পার্ক এখানেই অবস্থিত। বাসস্ট্যান্ড এর রাস্তায়ও এস.বি. আই এর  ব্যাংক ব্রাঞ্চ  আছে।


 ডি.সি হিল এবং বাবুপাড়া মোড় দিয়ে তুরা পিক এ উঠার পথ। কেউ তুরা পিক এ উঠতে চাইলে এখান দিয়ে উঠতে হবে। যাওয়া ৩ ঘন্টা এবং ফিরতে প্রায় ২ ঘন্টা।


শহর থেকে ৭-৮ কিমি বাইরে পাহাড়ের বুকে একটি নতুন বাসস্ট্যান্ড হয়েছে এটি আই.এস.বি.টি নামে পরিচিত। এখনও তেমন চালু হয়নি বাস স্ট্যান্ডটি তবে এই জায়গাটিও ভালোই।


দর্শনীয় স্থান

আসলে একটা জনপদের কিছু বিশেষ স্পট থাকলেও একজন ট্রাভেলার গোটা চিত্রটি, সবটা ক্যানভাস ই দেখেন।  গোটা মেঘালয়ের মধ্যে তুরার কথা যদি বলি এখানকার জীবন যাপন, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, বিভিন্ন জাতিসত্তার সহাবস্থান বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের দাবী রাখে। এছাড়া পাহাড়ি জনপদ মানেই যেন একটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। কোন একটি স্পট প্রকৃতপক্ষে একটি গন্তব্য হতে পারে, কিন্তু গন্তব্যে পৌছানোর পথ পরিক্রমাটিও কি একটি উপভোগ্য বা অর্জনযোগ্য সময় নয় ! এখানে অনেকগুলো ছোট বড় পাহাড়ি ঝর্ণা যেমন - পেলগা (শহর থেকে ১০ কিমি)। 

পেলগা দারে

পেলগা দারে

এই পথেই রংমেরাম ফলস ৭ কিমি। শহরেই গাঙরেকদারে নামে ছোট একটি ঝর্ণা রয়েছে। পেলগা যাওয়ার পথেই পরে পি.এ সাংমা স্টেডিয়াম। পেলগা যেতে হবে সি.এন.জি যোগে। ভাড়া আসা যাওয়া ৬০০-৭০০ রুপি।


চিবাগ্রি এখানকার একটি পিকনিক স্পট (আই.এস.বি.টি’র পথে) যা শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে অবস্থিত স্থানীয়দের কাছে এটি বিশেষ বিবেচিত হলেও এখানে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে এই পথে পাথুরে নদী গানোল আকর্ষণীয়। আসলে মেঘালয়ের নদীগুলো যেহেতু পাহাড়ে তাই সবগুলোই পাথুরে নদী। রংরাম কিংবা আসানাং হয়ে কেউ যদি নকরেক কিংবা রংবেং যায় তাহলে পথে এই গানোল রিভার পড়ে।

গানোল রিভার



এছাড়া এখানকার সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্পট নকরেক ন্যাশনাল পার্ক। পার্কের একটি বিশেষ ভিউ পয়েন্ট স্পট দারিবক এ অবস্থিত। এটি নিয়ে আমি একটি আলাদা লেখা লিখব।


তুরা পিক
সি লেভেল থেকে প্রায় ৯০০ কিমি উচ্চতার এ পাহাড় চূড়াটি এখানকার ট্রাভেলারদের একটি আকাঙ্খিত জায়গা। নিচের ছবির যে পথটি উপরের দিকে সেটি তুরা পিক এ উঠার পথ, আর যেটি নিচের দিকে সেটি ডিসি পার্কের পথ।



এছাড়াও বাবুপাড়া দিয়ে তুরা পিক এ উঠার আরো একটি পথ রয়েছে -



এখান থেকেই তুরা পিক এর যাত্রা শুরু। পথে পড়বে ঘন জঙ্গল, ছোট বড় নানা বৃক্ষ, গুল্ম, নানাপ্রকারের জীব বৈচিত্র। ঝর্ণার শব্দের সাথে ভেসে আসবে বানর দলের উচ্চ স্বরের হাঁক ডাক। বেশ কিছুটা পথ পাথর বিছানো থাকলেও বেশিরভাগ অংশটুকুতে কেবল ঝূপ বেষ্ঠিত একটা ট্রেইল। ৩ ঘন্টা হাঁটলে পৌছা যাবে চূড়ায়। বর্ষায় এই পরিকল্পনা করা অনুচিত।

ট্রেইল



একেবারে চূড়ায় রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। এখান থেকে সমগ্র তুরা শহর এবং সমতল ভূমি দেখা যায়।


পিক এর মাঝপথ থেকে দেখা থেকে তুরা শহর


হাওয়াখানা
তুরা শহরটির একটি ওয়াইড ভিউ এই হাওয়াখানা থেকে পাওয়া যায়। আপার হিল, লোয়ার হিল, পাহাড় আর শহরের একটি বিস্তৃত মনোরম চিত্র দেখতে চাইলে এই হাওয়াখানা থেকে দেখতে হবে। এখান থেকে দেখলে তুরা শহরটিকে চমৎকার একটি শৈল শহর হিসাবে অনুধাবন করা যায়।



সমাপন

যারা সৌখিন ট্যুরিস্ট, গ্ল্যামার স্পট পছন্দ করেন তাদের এ জায়গা নিরাশ করতে পারে। তবে যারা ট্রাভেলার বিভিন্ন জাতিসত্বা কিংবা ভৌগলিক প্রকৃতি যাদের আগ্রহের বিষয় তারা একবার বেরিয়ে আসতে পারেন। কিংবা সেভেন সিস্টারে সংক্ষিপ্ত পথ হিসাবেও এ পথকে বেছে নেয়া যেতে পারে। 

দায়মুক্তি

এই লিখনের নানা তথ্য এবং ছবি লেখকের পর্যবেক্ষণকৃত। কেউ এর থেকে কোন তথ্য পেয়ে উপকৃত হলেও হতে পারেন। এর থেকে কোন তথ্য ছবি নিজের বলে চালিয়ে দিলেও লেখকের কোন আপত্তি থাকবে না।

বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৩

শিলচর ; অনাকাঙ্খিত এক ভ্রমণের বৃত্তান্ত

হাফলং এর দ্বিতীয়বারের এবারের ভ্রমণটা তৃপ্তিদায়ক যেমন তেমনি নস্টালজিকও। ঝুমবৃষ্টিতে স্টেশনে দ্বিতীয়বারের মতো আগমন আগেরবারের অনুভূতির থেকে বেশ ফারাক। পাহাড়ি ঢল কিছুদিন পূর্বেই সাজানো গোছানো স্টেশনের অনেকাংশ, স্টেশন থেকে হাফলং বাজারের পাহাড়ি খাড়া রাস্তাটির অনেক জায়গায় ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে। 


আগেরবারের তাড়াহুড়োর ভ্রমণটিতে এই শৈল শহরের ভাঁজ- খাঁজগুলো, যাপনের অনাবিষ্কৃত রংগুলো এইবার চেহারা পেয়েছে। এখন চোখ বুঝলেই মোড়গুলো, সন্ধ্যা, পাহাড়ের রাত, কোন চূড়াটিতে বাজার, কোনটিতে ভিউ পয়েন্ট, কোনটিতে সিনট চার্চ, চার্চের ডানে অনেক নিচে কিংবা ডানপাশ ঘেষে ডানদিকে উপরে হাসপাতাল, হাসপাতালে উঠার মুখে বাম পাশে সর্পিল গাঁ বেয়ে উঠে তারপর নিচের দিকে মন্দিরের সামনের বিশাল পাহাড় আর গিরি খাদের নির্জনতা, শহরেই ডিসি হিলের চত্বর থেকে রেলওয়ে ব্রিজ আর বিষন্ন গম্ভীর পাহাড় সারি। পাহাড়ি ঢালের সন্ধ্যার মম'র দোকান সব চারপাশে বিরাজ করে।

জাতিঙ্গা এইবার আরও মস্ত হয়েছে, আরও গম্ভীর। এইবার মনখারাপের কারণ হয়েছে গিরিন চেটিয়া লজ এর অপমৃত্যু। ভস্মরুপ স্মৃতির আগুন নিভে গেছে একেবারেই। সে পাহাড় সে লজ এখন জঙ্গলাকীর্ণ ভগ্নাংশমাত্র। কি ভীষণ দুঃখের!  গিরিন চেটিয়ার গলাটি শুনতে পেলাম, বদলের ঠিকানা আরো গহিনে হওয়ায় এমনকি সেখান থেকে সংযোগও স্থাপন করা গেলো না। গিরিন চেটিয়া আজন্ম এক হারিয়ে ফেলা প্রিয়জন হয়ে গেলেন কি! জানি না।

তিনদিন ছুঁয়ে দেখে, ট্রেনের ডে অফ আর টিকিট অপ্রাপ্তির কারণে অপেক্ষমান না থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকার আকাঙ্খায় পরদিন শিলচরের ট্রেনে চেপে বসলাম। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ৪ ঘন্টা।


প্রত্যাশাতীত হয়েও, নতুন এ জনপদ মায়ার ফাঁদ বিছানো। বদরপুর থেকে বাইপাস ধরে ঘন্টা খানেক। মাঝে বিল, কচুরিপানার ফুল, শালিক, বক, মাছরাঙা। ভাঁটপাতা, শিয়ালমুতি, মাছ ধরার জাল, জংলা পাড়ের শাড়ি। প্রদেশ আলাদা হয়েও মাঝপথের এক স্টেশনের নাম অরুণাচল। অরুণাচল পার হয়ে অল্পখানি যেতেই ভিন্ন ঐতিহ্য আর ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা; ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিগাঁথা, স্টেশন চত্বরের সৌধ।


 অনতিদূরে গান্ধিপার্ক আর মাঝারি বাংলা বাড়ি ছাড়িয়ে গাঙ্গিনাপাড় টু নতুন বাজার সদৃশ্য সেন্ট্রাল রোড। শিলচরের সেন্ট্রাল পয়েন্ট। এই রাস্তাতেই হোটেল স্লিপ ইন এ আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছে।


 ব্যস্ত রাস্তা জুড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ নানা স্ট্রিট ফুড এর সমাহার। পাটিসাপ্টা সহ কতো পিঠার পুরনো ছোটখাটো  দোকান। ফরিদপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার সহ বাংলাদেশের নানা জায়গার নামের নানা দোকান যেনো এক টুকরো বাংলাদেশ। দেশভাগের ক্ষত এখানে শুকায়নি। আরেক দূর্ভাগা পাঞ্জাবের একটা ব্যাংককেও দেখলাম। দুই দূর্ভাগা- বাংলা, পাঞ্জাব।


সুপার শপ, সিনেপ্লেক্স এর সাথে পাল্লা দিয়ে এই পথের উপরেই মাঝারি মানের হোটেল, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত সকল শ্রেণীর নানা কর্মযজ্ঞ চলছে সমানতালে। সবখানেই পূজোর ভীড়।


নামটা বিস্মৃতি হয়ে গেছে, এই পথের ই একটা খাবার হোটেল এর সরিষা ইলিশ স্থায়ী সুখস্মৃতি হয়ে গেছে। এতো তৃপ্তি নিয়ে কিছু খেয়েছি বলে তো আর মনে পড়ে না।  সপ্তমীর পূজোর সন্ধ্যায় দীর্ঘ এই রাস্তার মন্ডপগুলোতে দর্শনার্থী নারীপুরুষ এর ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া, একলা হয়ে যাওয়া জগতের আনন্দ মুহুর্তগুলোর একটি। সচেতনভাবে লক্ষ করেছি মন্ডপগুলোতে বাংলা ছাড়া অন্য একটা গানও বাজেনি। এটি কি সচেতন জেদ কি না জানি না। 


জীবনের বৈচিত্র, যাপনের ব্যস্ততা মন্থনে শিলচর জীবনের একটা দিন দাবি করতেই পারে। গ্ল্যামারের খুচরোর বাইরে মায়ার দৌলত বিছানো অনেক জনপদের মতোই শিলচরও মায়াময়। পরদিন সকাল ৮ টার ট্রেনে চেপে বিকেলে ত্রিপুরায় পৌছার মধ্যিখানে ক্ষণিক এই যাত্রা বিরতি কি সুখের যে হলো! পর্যাপ্ত ছবি তোলা হয়ে উঠেনি। শিলচরের একটা ল্যান্ডস্কেপ তবু মনে থেকে যাবে।


বুধবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৩

হাওর জং (সুনামগঞ্জ) ; লৌকিক পথ

সূফি সন্ধানমূলক এই ভ্রমণটির পথ যে যথেষ্ট দূর্গম হবে তা মাথায় রেখেই এই পথ পরিক্রমা।। আত্মসন্ধানমূলক এ জাতীয় ভ্রমণে মানসিক প্রাপ্তির সম্ভাবনাটাই মূখ্য।  পাঁচশো কিমি এর এই বাইক ভ্রমণ শেষাবধি ছয়শোতে পৌছায়। অসংখ্য হাওর নদী জনপদ পারি দিয়ে শেষে আমাদের গৃহে ফেরা। এই পথ পরিক্রমণের দূর্গমতা ছিলো আনন্দধাম আবর্তনের শামিল। এই পথ পেরোতে প্রয়োজন  শুধু শুষ্ক মৌসুম, সুস্থ বাইক আর ক্ষুধা। সৌখিন পরিব্রাজকদের এ পথ পেরোনোতে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ । অতটা ডিটেইলের বিরম্বনার থেকে চুম্বক অংশই মেদহীন হবে। ক্ষমা আর প্রেম মনে থাকলে দুনিয়া সুন্দর।



ময়মনসিংহের ত্রিশাল যাত্রাবিন্দু হওয়ার কারণে কুয়াশার ভোরে সব্জীচরের ফারি পথে বালিপাড়াস্থ ব্রহ্মপূত্র ব্রিজ হয়ে পাড় হয়ে নান্দাইল চৌরাস্তা, সেখান থেকে আঠারোবাড়ি হয়ে কেন্দুয়ায় গিয়ে সকালের নাস্তা সেরে জালাল খাঁর বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য থাকলেও ভূল নির্দেশনায় আমরা মদন এর দিকে অর্থ্যাৎ উল্টো দিকে ১০ কিমি চলে গেলে মন খারাপ হয়। না ফিরে সামনে যাওয়ার ই সিদ্ধান্ত নিই। পরে সেখানে যাওয়ার মনস্থির করি।

সাঁইঢুলি

 
সরিষা হলুদ শুষ্ক সাঁইঢুলি ছাতি বেয়ে কিনার ধরে মদনের বিখ্যাত মাজার হয়ে খালিয়াজুড়ির মুখ। মদনের উচিতপুর থেকেই হাওরের ভূমিকা। 

ধনু নদীর পার ঘেষে জগন্নাথপুর এর ছোট বাজার ঘেষা গ্রামের কর্মমেদুর পাড়া ঘেষে রসূলপুর ঘাটে ধনুর ফেরি পার হয়ে হাওরের ঢালাই পথে পৌছি খালিয়াজুড়ি।


পথ পাশের বৃক্ষতলে পরিত্যক্ত মূর্তির দেবতাগণ, গরুচড়া বিস্তৃত মাঠ, প্রাকৃতিক পুষ্ট ঘাসের বাওয়াল, ঘোড়াচুলি হাওর, কাওর বান্দা হাওর সহ নানা নাম না জানা হাওর পাড়ি দিয়ে আমরা পৌছি স্থলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছোট চর উপজেলাটিতে। 


চা বিরতি, যান বিশ্রাম পরে সুনামগঞ্জের এদিককার এন্ট্রি পয়েন্ট শাল্লা দিয়ে গন্তব্য দিরাই। ১১ উপজেলার ০৯ টিতেই এ যাত্রায় আমাদের পা পড়েছে। দিরাই এ শাহ আব্দুল করিম এর বাড়ি। সদর থেকে ৭ কিমি।


বিকেলের রক্তিম আভায় হাওর এর মাঝ দিয়ে কংক্রিট এর রাস্তা ধরে কালনি ঘাটে শাহ আব্দুল করিম মিউজিয়াম। কালনির শূণ্য ঘাটপাড়ে করিম নৌকা বাঁধা।

মিউজিয়াম এর পিছনে চিরনিদ্রায় শায়িত গানের পাখি আর কবিপ্রেম সরলা। এখনও কি করিম উদাস হন!  কালনির ওপারে এই শুকনো প্রান্তরেও  জলের থৈ থৈ ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি কি চোখ বন্ধ করে মন্থন করেন! 

মিউজিয়াম 

বিষাদের প্রেম পাখী থেকে বিদায় নিতে সন্ধ্যা ঘন হয়ে  আসে। দিরাই এ নিশিযাপন করে (আবাসনের ব্যবস্থা এর চেয়ে মন্দ আরো হয় কি না জানা নাই, তবে করিমখানাতেও থেকে যাওয়া যেতো) পৌষ কুয়াশায় কালনিসেতু পাড় হয়ে ধামাইল স্রষ্টা রাধারমনপাড়ে পৌছতে ভাঙাচোরা ঢালাইপথ, আইল পথ, হাওর, চেরাচেপ্টি নদী, আর পাড়ি দিতে হয় বোয়াল, আইর নিবাস মহাত্মা নওল্লার হাওর। কষ্টের আনন্দ গালিব জানে।

নওল্লার হাওর 


আঠারো শতকের রাধারমনের সর্বস্ব নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে তার নিশানা। জমি-জমা সব যার যার মতো বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন বঙ্গসন্তান। 

সমাধি মন্দির এর ভিতরভাগ

পরিবার পরিজন দেশত্যাগ করেছেন বাটোয়ারার বছর। তারপর কাঁটাতার পাসপোর্ট ভিসার বাঁধায় হারিয়ে গেছে তার রক্তের ফুল। অতটা আলোয় পাছে চারপাশ আলোকিত হয়ে কারো চোখ ধাঁধিয়ে যায়, দৃষ্টিশক্তিতে চাপ পড়ে!

 
দত্তকে মুর্শিদজ্ঞান করা ভক্ত দত্তের খড়ম বুকে নিজ ব্যায়ে বাড়ির উঠোনে পুকুর পাড়ে গড়েছেন ছোট্ট সমাধি মন্দির।

রাধার ঘর আশপাশে কোথাও ছিলো অতটুকু তৃপ্তি, আর চির বিচ্ছেদ - "আগে যদি জানতামরে ভ্রমর....." বুকে নিয়েই ফিরতে হবে প্রেমিক কে।


রাধা রমন এর থেকে আমাদের যাত্রা আঠার শতক এর আরেক গীতিকবি সুনামগঞ্জ সদরে সুরমা পারের হাসন রাজার দরবার। 

বংশধরেরা নতুন বাড়ি করলেও টিনের দুটো ঘর এখনও টিকে আছে। রাজগৃহ জঙ্গলাকীর্ন, জলসাঘর প্রয়াত। সুরমার উপচে পড়া জলের ছোবলে হাসন মিউজিয়ামের মূমুর্ষতা কাঁটেনি এখনও।

পুরাতন গেইট

কালের ভাঁজে সুরমার পলি শক্ত হয়ে বাড়ির পাশে হয়ে গেছে মাটি। বস্তি, স্কুল, দালানের জংলা হয়েছে সেখানে । বাড়ির পাদপাশেই তাহিরপুর টাঙ্গুয়ার হাওর এর সুরমা ঘাট। এ ঘাট থেকেই রিজার্ভে মিলে নানা মাত্রার বিহার বুট।


দুপুরের খাবার সেরে ছোট্ট মিউজিক বক্স কিনে সুরমা পার হয়ে লাউডে গান শুনতে শুনতে শনির হাওর সহ নানা নাম না জানা হাওর পাড়ি দিয়ে তাহিরপুর। মাঝপথে মহাসিং নদীর তীরে শতোর্ধ দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদ দর্শন।

 তাহিরপুরে চা-যান বিরতি দিয়ে সন্ধ্যার মাটিকাটা হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর সহ নানা হাওর নদী পাড়ি দিয়ে মেঠোপথ বেয়ে ঘন সন্ধ্যায় মেঘালয়ের পাহাড়ের পাদদেশে বড়ছড়ার বাজারের মাঝারি হোটেলে কুয়াশার্ত নিশীযাপন।

 
সকালে বড়ছড়া শুল্কস্টেশন এর মনোরম পাহাড়ি পথ হয়ে বড়দিনের আমেজ ছোট্ট নতুন পাহাড়ি গির্জা রেখে শাহ আরেফিন এর আস্তানা উদ্দেশ্যে বারিক্কা টিলার পাদদেশ থেকে যাদুকাঁটার ঘাট থেকে নৌকাযোগে ওপারে আস্তানায় পৌছি। 


বড়ছড়া থেকে মাইল ছয়েক পাহাড়ি পথ আর ওপাড়ে আস্তানাপাশেই বর্ডার হাঁট। 

বর্ডার হাঁট 

তরফ বিজয়ের সময় হযরত শাহ আরেফিন (র.) হযরত শাহজালাল (র.) সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের (র.) সঙ্গী ছিলেন। তিনি লাউড়েরগড় যাওয়ার সময় বর্তমান সুনামগঞ্জের যে স্থানে রাত্রি যাপন করেছিলেন, সে স্থান পরবর্তী সময়ে আরফিননগর নামে অভিহিত হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পরে তিনি লাউড়েরগড় গ্রামের কাছে খাসিয়া পাহাড়ের কাছে আস্তানা গাড়েন এবং তদানীন্তন লাউড় রাজ্যে ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। 

আস্তানা থেকে মাইলখানেক পরে পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত লাউড়ের গড়। ময়মনসিংহ সুনামগঞ্জ নিয়ে গঠিত এই রাজ্যের ধ্বংসাবশেষও নদীগর্ভে বিলিয়মান।
লাউড়েরগড় থেক অনতিদূরে ঐতিহাসিক পণাতীর্থ। 

পূর্বপাড় এর মন্দির

কুবের আচার্য এবং নাভা দেবীর পূত্র কমলাক্ষ।
শ্রীশ্রী অদ্বৈতাচার্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম কমলাক্ষ। তিনি নবদ্বীপে শিক্ষালাভ ও শান্তিপুরে অধ্যাপনা করেন। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তার নাম দেওয়া হয় অদ্বৈত। পঞ্চদশ শতকে তিনি 'চৈতন্যবিষয়ক পদ' রচনার সূত্রপাত করেন। তিনি বৈষ্ণব সাহিত্যে শ্রীশ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভু হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। লাউড়ের রাজা স্বয়ং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে 'লাউড়ের কৃষ্ণদাশ' হন। অদ্বৈতের মতো তীর্থরাও 'পণ' করেছিলেন, প্রতি বারুণীতেই সেখানে তাদের আবির্ভাব ঘটবে। এই 'পণ' শব্দ থেকেই পণাতীর্থের নাম হয়েছে। এই পণাতীর্থকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূণ্যস্থান মনে করেন। এই পণাতীর্থকে কেন্দ্র করে চমৎকার এক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
নদীর উভয় পাশে পণাতীর্থকে কেন্দ্র করে দুইটি মন্দির রয়েছে। মন্দিরে অনেক মানুষের সমাগমহেতু অনেক আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে। যে কেউ এখানে সাদরে আতিথ্য গ্রহণ করতে পারেন; বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বিরা। নদী পারাপার এর ঘাটটিতে সেতু নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

পশ্চিম পাড় এর মন্দির

ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে একইসাথে তিনদিন ব্যাপী শাহ আরেফিন এর আস্তানা এবং পণাতীর্থকে কেন্দ্র করে বিশাল উৎসব চলে এখানে। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য অনবদ্য। বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা এখানে যাদুকাঁটা নদী কেন্দ্রিক।

বালি খুড়ে পাথর, কয়লা, জ্বালানী উত্তোলন এবং তা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন বিশেষত খরস্রোতা এ নদীর মেজাজের উপর ই নির্ভরশীল। একসাথে এত নৌকাযোগে এতো বড় কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশ আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নাই।

লাকমাছড়া

দুপুরে ফিরে বড়ছড়া বাজারে খেয়ে  নিলাদ্রি লেক হয়ে পাশেই লাকমাছড়ার পাশে সন্ধ্যা । হোটেলে ঘন্টাখানেক দিনের ধূলো মুছে ছোট বাজারে পায়চারি, শীতার্ত চা স্টলে মানুষের আড্ডা আলাপে ঢুকে যাওয়া। রাতের খাবার খেয়ে মিউজিক শুনতে শুনতে ঘুম।

 
ভোরের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কুয়াশা আর মেঘের ডুয়েট প্রতিপক্ষের হুমকি উপেক্ষা করে তৃতীয় দিন সাতটার ভিতরে পশ্চিমমুখী বর্ডার রোডে বাইক চাপিয়ে মহিষখোলা পৌঁছাতে ঘন্টাখানেক। কাঁচাপাকা রাস্তার ডানপাশে পাহাড় বামে হাওর। দূর্গাপুর থেকে মহিষখোলা হয়ে আরেকবার এ পথে আমার ট্যাকেরঘাট যাওয়ার অভিজ্ঞতা চমৎকার দূর্ধর্ষ।


মহিষখোলা চৌমুহনি থেকে বামে মোড় নিলে টাঙ্গুয়ার হাওর এর পশ্চিমপাড় ঘেষে যুদ্ধবিদ্ধস্ত রাস্তা ধরে মধ্যনগর পর্যন্ত ১০ কিমি এর মতো পথ। ইটের সলিং এর এই রাস্তার ইটগুলো সাজিয়ে পথ তৈরির বদলে যেন স্তুপাকারে যথেচ্ছার করে প্রতিবন্ধকতা তৈরিই ইটার্ত পথের ইটষ্কাম। ১০ কিমি পথ পাড়ি দিতে সময়ের পরিমাণ ঘন্টাতিরিক্ত, আর মনোপেশিজ উত্তেজনা। মাঝপথে শুষ্ক হাওড়ে সরিষার বাগ।


 মিনিটপাঁচেক এক অনাবৃষ্টি যেন এই পথকে স্মরণীয় করে তোলার প্রাকৃতিক ব্যাঙ্গের চূড়ান্ত কান্ড। আরও কিছু সিক্ত পথহীন পথ, সুমেশ্বরীর বাঁশের সাঁকো পাড়ি দিয়ে মধ্যনগর বাজার। এখানেও সেতু নির্মাণের কাজ চলমান। হাওর বাঁধের উপর দিয়ে মধ্যনগর বাজারপাড়ের ঘাট থেকে ফেরি পাড় হয়ে সোজা ১০ কিলো পরে গাছতলা বাজারে সকালের নাস্তা। মধ্যনগর পৌছার অধিকতর সুশ্রী পথটা তাহিরপুর হয়ে। ও পথে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত ই উত্তম।

 
এখান থেকে ডানপাশের রাস্তা ধরে ময়মনসিংহের শর্টকাট। এই রাস্তা ধরেও টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার আরেকটি লিখায় আছে । বাম পাশেরটি ধরে ময়মনসিংহ যাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে আরও একটি লিখায়। এইবার নিয়ে ট্যাকেরঘাট যাওয়া আমার চারবার এবং  চারবার ই ভিন্ন পথে।


বামপাশের রাস্তা ধরে বাদশাগঞ্জ ধর্মপাশা হয়ে এবারের গন্তব্য উকিল মুন্সির বাড়ি। গুগল ম্যাপের বিভ্রান্তিকর পথ ধরে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পড়ি বিখ্যাত ডিঙ্গাপোতা হাওরে। ঋষিগণের ধ্যানে কৃষিযজ্ঞ মাঠজুড়ে। এখান থেকে যেতে হয় উকিলমুন্সি বাজারে। বাজার থেকে সোজা মাইলখানেক। এই হাওরে পথ হারিয়ে ক্ষণিক বিরক্তও হই, গুগল মাথা ছাড়ে। বেশ কিছুক্ষণ আগু পিছু এদিক ওদিক করে ক্লাইম্যাক্স শেষে মিলন দৃশ্য। ভেদাই নদীর পাড়ে টেরাকোটার অলংকারে সাজানো হয়েছে দৃষ্টনন্দন উকিলমুন্সি কমপ্লেক্স, বাঁশের সাঁকো পাড় হয়ে যেতে হয়  ওপাড়ে। 


কমপ্লেক্সে মুন্সি আর মুন্সিপূত্রের যুগল সমাধি। কমপ্লেক্সের কাজ সমাপ্ত প্রায়। পিছনেই কমপ্লেক্স আদলেই করা হয়েছে ছোট্ট নিবাস। বৃদ্ধা মুন্সি পূত্রবধূ থাকেন সেখানে। শুনেছি ওদিক দিয়ে দুটো নদী পার হতে হয় এমন একটি রাস্তা আছে। এক্সপেরিমেন্ট এর সাধ আমাদের ইতিমধ্যেই শোকগ্রস্থ।


 
বিকাল এর সূর্য আমাদের তাড়া দিচ্ছে। ডিঙ্গাপোতার গোলকধাঁধাঁ, আঁকাবাঁকা শীর্ণ পিচের পথ পেরিয়ে আমরা ছুটছি মোহনগঞ্জকে নাকে রেখে। মোহনগঞ্জ বাজার, রেলস্টেশন ছাড়িয়ে চাকা উপযুক্ত পথ পেতেই গতি বাড়তে থাকে। সন্ধ্যাচাবুক পড়ছে পিঠে।

নেত্রকোনা শহর থেকে মাইলখানেক পরে বা আগে নবনির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পিছনে গীতিকবি গুরুর গুরু বাউল রশিদ উদ্দিন এর বাড়ি এবং কবর। 


জালাল খাঁ, উকিল মুন্সি, শাহ আব্দুল করিম এর গুরু এবং গুরুসম মালজোড়ার স্রষ্টা রশিদ উদ্দিন। বিচ্ছেদ এর চেয়ে যার আধ্যাত্মিক গানের সংখ্যা বেশি। আধ্যাত্মিকতায় থাকে সাধনার সুবাস। তার অজস্র গান অন্যের নামে কিংবা অজ্ঞাত  পরচিয় হয়ে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ঘুরছে বাঙাল মুল্লুকে। বাঙালীর আত্মপরিচয়, সবচেয়ে অবহেলিত বাংলার রত্ম রশিদ উদ্দিন এর তৃতীয় পুরুষদের ঋণাত্মক আবেগঘন রসে সন্ধ্যা ভারি হয়ে আসে।

বিদায় নিয়ে আপন নিবাসে নেত্রকোনা সদর হয়ে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ থেকে ত্রিশাল। একটা কড়কড়ে ভ্রমণের যবনিকা।
যৌবন তুমি দীর্ঘজীবী হও। আরো কিছুদিন বাঁচো আমাদের শরীরে। 

সোনাদিয়া : আ ডিজার্টেড আইল্যান্ড

 সময়কাল ২০২৪।  কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর জনাকীর্ন তিনটি পয়েন্ট ডলফিন মোড় থেকে শুরু। প্রথমটি কলাতলী শেষেরটি লাবণী আর মাঝের পয়েন্টটির নাম সুগন্...