আবেশন
ময়মনসিংহ শহর থেকে নাকুগাঁও পর্যন্ত মোট ৭৬ কিমি পথ। বাস সি.এন.জি তে নালিতাবাড়ি পর্যন্ত ৬৩ কিমি পথ গিয়ে অবশিষ্ঠ ১৩ কিমি পথ অটো রিক্সা, সি.এন.জি কিংবা ভাড়া মোটর বাইকে সহজেই পৌছে যাওয়া যায় নাকুগাঁ স্থলবন্দরে। এই বন্দরটি দিয়ে পাথর ভর্তি ট্রাক মেঘালয় আসাম থেকে আসা যাওয়া করে। বহু শ্রমিকের কর্মস্থল এই স্থলবন্দরটি।
এই বন্দরের বাংলাদেশ অংশের নাম নাকুগাঁও এবং ভারতীয় পোর্ট এর নাম ঢালু। ঢালু পোর্ট দিয়ে ভিসা করে নাকুগাঁঁও অংশে ইমিগ্রেশন, কাস্টম্স অফিসে ট্রাভেল ট্যাক্স ১১০০ টাকা দিয়ে, এবং বিজিবি চেক এর পর ( ইমিগ্রেশন, কাস্টম্স এবং বিজিবি ৩ টি পয়েন্টেই নাম এন্ট্রি করবে) , ঢালু অংশে একই প্রসেস সারতে হবে।
এই পোর্টে ভীর সবসময় ই অন্য পোর্ট এর থেকে কম হলেও উভয় পয়েন্ট এর কাজ সারতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। ঢালু অংশে ইমিগ্রেশন অফিস কাস্টমস অফিস থেকে ১ কিলোমিটার এর মতো দূরে। না হেঁটে একটা অটো নিয়ে কাস্টমস এর কাজ শেষ করে ইমিগ্রেশন অফিস যাওয়াই ভালো। তবে এখানে কাস্টম্স অফিস থেকে ইমিগ্রেশন অফিস পর্যন্ত যাওয়ার সময় কোন বাহন না পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ।
![]() |
ঢালু ইমিগ্রেশন অফিস |
বৈঠকখানার মতো একটা ঘরে এখানে ইমিগ্রেশন অফিস হেল্পফুল। দিনে ৩০-৪০ জন যাত্রী এ পথে আসা যাওয়া করে, সেকারণেই হয়তো ইমিগ্রেশন অফিস আধুনিকায়ন এর কোন পরিকল্পনা নেয়া হয় না। ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের জন্য এ পথে সেভেন সিস্টারের বিশেষ করে মেঘালয়, আসাম, অরুণাচল এমনকি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব অংশে (শিলিগুড়ি, কুচবিহার, সিকিম, দার্জিলিং) যাওয়া অপেক্ষাকৃত উত্তম সহজ পথ (ত্রিপুরা বাদে)।
মানি এক্সচেঞ্জ
তুরা’র পথে
গারো বিশ্বাস মতে, পাওয়ারফুল গড ‘ডুরামা আম্বামা’র নাম অনুসারে এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ পাহাড় সারির নাম ‘ডুরা আগ্রি’ বা ডুরা হিল ডাকা হতো। ব্রিটিশরা পরবর্তীতে একে ‘তুরা’ নামে সম্বোধন করতো। বর্তমানে সকলেই একে ‘তুরা’ নামে ডেকে থাকে।
ইমিগ্রেশন অফিসের সামনে থেকে ২০ রুপিতে অটোতে করে বারেঙ্গাপাড়া বাজার। সেখান থেকে তুরায় পৌছার একাধিক প্রকারের বাহন আছে- উইঞ্জার (বড় মাইক্রো বা হায়েজ জাতীয় ১৩ সিটের গাড়ি) যাার ভাড়া ১৫০ রুপি সময় লাগে ১ ঘন্টা ১০ মিনিট। অপরটি হচ্ছে বাস; ভাড়া ১৫০ রুপি, এছাড়া অটো সি.এন.জি জাতীয় গাড়িতেও যাওয়া যায়। আমি প্রথমবার বাস এবং দ্বিতীয়বার যাওয়ার সময় উইঞ্জারে গিয়েছিলাম। উইঞ্জার বেস্ট অপশন।
ঢালু থেকে গাড়ি যাওয়ার সময় শুধু উঠবে আর আসার সময় শুধু নামবে। বিকাল ৩:৩০ এ শেষ বাস। ঘন্টাখানেক পর পর বাস পাওয়া যায়। এই পথে যে পাহাড়টা দৃষ্টিসীমায় সব পাহাড়ের সবচেয়ে উপরে থাকে সেটিই ‘তুরা পিক’ নামে পরিচিত।
![]() |
তুরা পিক |
যেতে যেতে তুরা পিক এর ঠিক চূড়ার কাছাকাছি তুরা বাজার বা তুরার গোটা শহর। বারেঙ্গাপাড়া থেকে ২-৩ কিমি এর সমতল পথ পাড়ি দিতেই পাহাড় বেয়ে বাস উঠে যাবে উপরের দিকে। পথে পড়বে ছোট ছোট আঞ্চলিক বাজার, স্কুল, মন্দির, ট্র্যাডিশনাল গারো বাড়ি ঘরের পিছনে পাহাড়ের ব্যাকড্রপ ইত্যাদি। তুরা বাসস্ট্যান্ড পাহাড়ের উপরে হলেও তুরা বাজার থেকে ডাউন হিল এ অবস্থিত। শহর এর সেন্ট্রাল পয়েন্ট তুরা বাজার। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা একাই এসব বাসে যাতায়াত করে। নিরাপত্তাহীনতা এখানে অপরিচিত শব্দ বলেই মনে হয়েছে।
![]() |
তুরা বাসস্ট্যান্ড |
হোটেল
![]() |
হোটেল রিকম্যান |
![]() |
হোটেল প্যারামাউন্ট |
![]() |
পলো অর্কিড |
জনজীবন
শহরটি তুরা পাহাড়ের উপরে নিচে মিলিয়ে গড়ে উঠেছে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নানা নন ট্রাইবালদের মধ্যে রয়েছে বাঙালী, বিহারী, নেপালি সহ কম বেশি নানা জাতীসত্বার মানুষ। ট্রাইবালদের মধ্যে গারো, হাজং, খাসি ।
![]() |
উপরে তুরা পিক |
বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সম্মিলন এখানে। সংখ্যাগত দিক থেকে সকল নন-ট্রাইবালদের সম্মিলিত পরিমাণ ট্রাইবালদের প্রায় সমানে সমান। তবে নন-ট্রাইবালরা এখানে রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত বলা যায়, নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে না। এ নিয়ে নন ট্রাইবালদের মধ্যে ক্ষোভ আছে এমন মনে হয়নি। নূন্যতম মুজুরি এখানে ১৫-২০ হাজার টাকার মধ্যে। যত্রতত্র প্রভাব চর্চা এখানে হয় না। মানুষ যথেষ্ঠ সুখী। যে সমস্ত বাঙালীদের সাথে কথা বলেছি তাদের প্রত্যেকের ই পূর্ব পুরুষ কোন না কোন সময় বাংলাদেশে ছিলেন বলে জেনেছি। উচ্চতর শিক্ষার জন্য তার শিলং কিংবা অন্য প্রদেশেও গমণ করেন, তেমনি উচ্চতর চিকিৎসার জন্যও তারা অন্য রাজ্যমুখী হন। হিন্দি সকলেই বুঝেন, বিভিন্ন ভাষাভাষির সাথে হিন্দিতেই ভাব চালাচালি করেন। বাঙালী পাড়া, বাঙালী স্কুল, গুর্খা স্কুল রয়েছে। সিনেমা হল নেই। নাট্যশালা, গানের দল রয়েছে। বহিরাগতদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র আছে বলে সন্ধান পাই নি। তুরা বাজার এলাকা পুরাতন, মধ্য এবং উচ্চবিত্তরা আপার হিলে নতুন নতুন স্থাপনা করেছেন। ডন বস্কো সহ ট্রাইবাল স্কুল কলেজ আপার হিলেই অবস্থিত। তুরা টিভি স্টেশনও আপার হিলে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা শহরের কাছাকাছি ই অবস্থিত।
![]() |
বিহারি |
তুরা বাজারের আশপাশে বিহারিরা দৃশ্যমান। বিহারিরা বিহার থেকে বংশ পরম্পরায় এখানে মালামাল লোড-আনলোড এর কাজ করে থাকে। বিহারিদের পরিবার বিহারে থাকেন, পুরুষরা যারা আসেন তারা সাধারণত একসঙ্গেই অবস্থান করেন।
গারোদের পারিবারিক ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। পাহাড়ি এই দূর্গম অঞ্চলটির প্রগতিশীলতা পূর্বে দেখা ভারতের অন্য অঞ্চল থেকেও অনেক বেশি। নারী পুরষের কোন ভেদ বা ফারাক নেই। খাদ্য দ্রব্য এবং অন্যান্য বহু সুবিদার জন্য তাদের বহিরাজ্যের শরনাপন্ন হতে হয়। তাই বিভিন্ন পন্য এবং সুবিধার জন্য এখানে অন্য রাজ্য থেকে বেশি মূল্য গুনতে হয়; কোথাও দ্বিগুন এর ও বেশি। সে হোক খাদ্যদ্রব্য কিংবা হোটেল সার্ভিস কিংবা যানবাহন।
শহর
![]() |
তুরা বাজার |
লাল হলুদ বিল্ডংটিই তুরা সুপার মার্কেট এর পশ্চাৎভাগ এবং এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে নীলাভ অংশটিই তুরার কাঁচা বাজার। এই রাস্তাটির উপরের মোড়টি সানদারে হোটেল এর মোড় লোকেরা একে সুন্দরী হোটেল বলে। উঁকি দেয়া পাহাড়টিই তুরা পিক। চূড়ার খুব কাছাকাছি হলেও শহর থেকে তুরা পিক এ উঠতে ৩ ঘন্টা, নামতে তার অর্ধেক সময়।
![]() |
সুপার মার্কেট এর সম্মুখভাগ |
৩ তলা বিশিষ্ঠ তুরা সুপার মার্কেটটি অন্য সুপার মার্কেটে প্রাপ্য পণ্যের প্রাচুর্য কিংবা পরিধিতে ছোট হলেও তুরাতে এটিই সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেস। আকর্ষণীয় কিংবা বিশেষ পণ্যের মার্কেট না হলেও এখানে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মুদি, কনফেকশনারি কিংবা বেকারি পণ্য একপাশে অপর পাশে ইলেকট্রনিক্স পণ্য। দু’তলায় খেলনা, ব্যাগ ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় কাপড়। তবে বাংলাদেশীদের জন্য এসব এদেশ থেকে তুলনামূলক বেশি দাম ই বলা যায়। তবে কিছু কেনাকাটা করতে চাইলে এখান থেকেই করতে হবে।
![]() |
তুরা সুপার মার্কেট (অভ্যন্তরভাগ) |
সুপার মার্কেট সামনের ছোট রাস্তাটিতেই বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ার বিভিন্ন সার্ভিস এর কাউন্টার, আর সামনে পিছনে সহ দু’পাশের ফুটপাতে সব্জী বা পাহাড়ি ফলমূল এর বাজার। পশ্চিম পাশে দুটো বাঙালী খাবার হোটেল আর সান্ধ্যকালীন স্ট্রিটফুড এর দোকান। রিকম্যান হোটেল এর সেকেন্ড ফ্লোরে ভিতরে একটি বাঙালী খাবার হোটেল রয়েছে।
এখান থেকে শিলং, শিলিগুড়ি, গুহাটি যাওয়ার বাস, সুমো জিপ, জাইলো নামে বড় মাইক্রোবাস সদৃশ একধরণের সার্ভিস চলাচল করে। অধিকাংশ সার্ভিস ই রাত ৮ টা থেকে। তবে সকালেও আছে। তুরা থেকে বাসে শিলং ৭-৮ ঘন্টা, গুহাটি ৬ ঘন্টা, শিলিগুড়ি ৮-১০ ঘন্টা সময় লাগে। ভাড়া ৬০০-৮০০ রুপির মধ্যে। শিলিগুড়ি রিজার্ভ জাইলো ১৫-১৭ হাজার টাকাঅ এছাড়া এখান থেকে হেলিকপ্টার সার্ভিস যোগে ৩০ মিনিটে শিলং গুহাটি পৌছা যায়।
![]() |
কাউন্টার |
সুপার মার্কেট এর ডানপাশের মোড় থেকে অপেক্ষাকৃত খাড়া উপরের দিকে পথটির অপর মাথায় ডিসি হিল। এই হিলে ডিসি অফিস অবস্থিত বলে একে ডিসি হিল বলে। এখানেই ব্যাংক কিংবা বুথ আছে। ছোট ডিসি পার্ক এখানেই অবস্থিত। বাসস্ট্যান্ড এর রাস্তায়ও এস.বি. আই এর ব্যাংক ব্রাঞ্চ আছে।
ডি.সি হিল এবং বাবুপাড়া মোড় দিয়ে তুরা পিক এ উঠার পথ। কেউ তুরা পিক এ উঠতে চাইলে এখান দিয়ে উঠতে হবে। যাওয়া ৩ ঘন্টা এবং ফিরতে প্রায় ২ ঘন্টা।
শহর থেকে ৭-৮ কিমি বাইরে পাহাড়ের বুকে একটি নতুন বাসস্ট্যান্ড হয়েছে এটি আই.এস.বি.টি নামে পরিচিত। এখনও তেমন চালু হয়নি বাস স্ট্যান্ডটি তবে এই জায়গাটিও ভালোই।
দর্শনীয় স্থান
![]() |
পেলগা দারে |
![]() |
পেলগা দারে |
![]() |
গানোল রিভার |
![]() |
ট্রেইল |
![]() |
পিক এর মাঝপথ থেকে দেখা থেকে তুরা শহর |