বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৩

শিলচর ; অনাকাঙ্খিত এক ভ্রমণের বৃত্তান্ত

হাফলং এর দ্বিতীয়বারের এবারের ভ্রমণটা তৃপ্তিদায়ক যেমন তেমনি নস্টালজিকও। ঝুমবৃষ্টিতে স্টেশনে দ্বিতীয়বারের মতো আগমন আগেরবারের অনুভূতির থেকে বেশ ফারাক। পাহাড়ি ঢল কিছুদিন পূর্বেই সাজানো গোছানো স্টেশনের অনেকাংশ, স্টেশন থেকে হাফলং বাজারের পাহাড়ি খাড়া রাস্তাটির অনেক জায়গায় ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে। 


আগেরবারের তাড়াহুড়োর ভ্রমণটিতে এই শৈল শহরের ভাঁজ- খাঁজগুলো, যাপনের অনাবিষ্কৃত রংগুলো এইবার চেহারা পেয়েছে। এখন চোখ বুঝলেই মোড়গুলো, সন্ধ্যা, পাহাড়ের রাত, কোন চূড়াটিতে বাজার, কোনটিতে ভিউ পয়েন্ট, কোনটিতে সিনট চার্চ, চার্চের ডানে অনেক নিচে কিংবা ডানপাশ ঘেষে ডানদিকে উপরে হাসপাতাল, হাসপাতালে উঠার মুখে বাম পাশে সর্পিল গাঁ বেয়ে উঠে তারপর নিচের দিকে মন্দিরের সামনের বিশাল পাহাড় আর গিরি খাদের নির্জনতা, শহরেই ডিসি হিলের চত্বর থেকে রেলওয়ে ব্রিজ আর বিষন্ন গম্ভীর পাহাড় সারি। পাহাড়ি ঢালের সন্ধ্যার মম'র দোকান সব চারপাশে বিরাজ করে।

জাতিঙ্গা এইবার আরও মস্ত হয়েছে, আরও গম্ভীর। এইবার মনখারাপের কারণ হয়েছে গিরিন চেটিয়া লজ এর অপমৃত্যু। ভস্মরুপ স্মৃতির আগুন নিভে গেছে একেবারেই। সে পাহাড় সে লজ এখন জঙ্গলাকীর্ণ ভগ্নাংশমাত্র। কি ভীষণ দুঃখের!  গিরিন চেটিয়ার গলাটি শুনতে পেলাম, বদলের ঠিকানা আরো গহিনে হওয়ায় এমনকি সেখান থেকে সংযোগও স্থাপন করা গেলো না। গিরিন চেটিয়া আজন্ম এক হারিয়ে ফেলা প্রিয়জন হয়ে গেলেন কি! জানি না।

তিনদিন ছুঁয়ে দেখে, ট্রেনের ডে অফ আর টিকিট অপ্রাপ্তির কারণে অপেক্ষমান না থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকার আকাঙ্খায় পরদিন শিলচরের ট্রেনে চেপে বসলাম। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ৪ ঘন্টা।


প্রত্যাশাতীত হয়েও, নতুন এ জনপদ মায়ার ফাঁদ বিছানো। বদরপুর থেকে বাইপাস ধরে ঘন্টা খানেক। মাঝে বিল, কচুরিপানার ফুল, শালিক, বক, মাছরাঙা। ভাঁটপাতা, শিয়ালমুতি, মাছ ধরার জাল, জংলা পাড়ের শাড়ি। প্রদেশ আলাদা হয়েও মাঝপথের এক স্টেশনের নাম অরুণাচল। অরুণাচল পার হয়ে অল্পখানি যেতেই ভিন্ন ঐতিহ্য আর ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা; ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিগাঁথা, স্টেশন চত্বরের সৌধ।


 অনতিদূরে গান্ধিপার্ক আর মাঝারি বাংলা বাড়ি ছাড়িয়ে গাঙ্গিনাপাড় টু নতুন বাজার সদৃশ্য সেন্ট্রাল রোড। শিলচরের সেন্ট্রাল পয়েন্ট। এই রাস্তাতেই হোটেল স্লিপ ইন এ আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছে।


 ব্যস্ত রাস্তা জুড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ নানা স্ট্রিট ফুড এর সমাহার। পাটিসাপ্টা সহ কতো পিঠার পুরনো ছোটখাটো  দোকান। ফরিদপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার সহ বাংলাদেশের নানা জায়গার নামের নানা দোকান যেনো এক টুকরো বাংলাদেশ। দেশভাগের ক্ষত এখানে শুকায়নি। আরেক দূর্ভাগা পাঞ্জাবের একটা ব্যাংককেও দেখলাম। দুই দূর্ভাগা- বাংলা, পাঞ্জাব।


সুপার শপ, সিনেপ্লেক্স এর সাথে পাল্লা দিয়ে এই পথের উপরেই মাঝারি মানের হোটেল, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত সকল শ্রেণীর নানা কর্মযজ্ঞ চলছে সমানতালে। সবখানেই পূজোর ভীড়।


নামটা বিস্মৃতি হয়ে গেছে, এই পথের ই একটা খাবার হোটেল এর সরিষা ইলিশ স্থায়ী সুখস্মৃতি হয়ে গেছে। এতো তৃপ্তি নিয়ে কিছু খেয়েছি বলে তো আর মনে পড়ে না।  সপ্তমীর পূজোর সন্ধ্যায় দীর্ঘ এই রাস্তার মন্ডপগুলোতে দর্শনার্থী নারীপুরুষ এর ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া, একলা হয়ে যাওয়া জগতের আনন্দ মুহুর্তগুলোর একটি। সচেতনভাবে লক্ষ করেছি মন্ডপগুলোতে বাংলা ছাড়া অন্য একটা গানও বাজেনি। এটি কি সচেতন জেদ কি না জানি না। 


জীবনের বৈচিত্র, যাপনের ব্যস্ততা মন্থনে শিলচর জীবনের একটা দিন দাবি করতেই পারে। গ্ল্যামারের খুচরোর বাইরে মায়ার দৌলত বিছানো অনেক জনপদের মতোই শিলচরও মায়াময়। পরদিন সকাল ৮ টার ট্রেনে চেপে বিকেলে ত্রিপুরায় পৌছার মধ্যিখানে ক্ষণিক এই যাত্রা বিরতি কি সুখের যে হলো! পর্যাপ্ত ছবি তোলা হয়ে উঠেনি। শিলচরের একটা ল্যান্ডস্কেপ তবু মনে থেকে যাবে।


বুধবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৩

হাওর জং (সুনামগঞ্জ) ; লৌকিক পথ

সূফি সন্ধানমূলক এই ভ্রমণটির পথ যে যথেষ্ট দূর্গম হবে তা মাথায় রেখেই এই পথ পরিক্রমা।। আত্মসন্ধানমূলক এ জাতীয় ভ্রমণে মানসিক প্রাপ্তির সম্ভাবনাটাই মূখ্য।  পাঁচশো কিমি এর এই বাইক ভ্রমণ শেষাবধি ছয়শোতে পৌছায়। অসংখ্য হাওর নদী জনপদ পারি দিয়ে শেষে আমাদের গৃহে ফেরা। এই পথ পরিক্রমণের দূর্গমতা ছিলো আনন্দধাম আবর্তনের শামিল। এই পথ পেরোতে প্রয়োজন  শুধু শুষ্ক মৌসুম, সুস্থ বাইক আর ক্ষুধা। সৌখিন পরিব্রাজকদের এ পথ পেরোনোতে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ । অতটা ডিটেইলের বিরম্বনার থেকে চুম্বক অংশই মেদহীন হবে। ক্ষমা আর প্রেম মনে থাকলে দুনিয়া সুন্দর।



ময়মনসিংহের ত্রিশাল যাত্রাবিন্দু হওয়ার কারণে কুয়াশার ভোরে সব্জীচরের ফারি পথে বালিপাড়াস্থ ব্রহ্মপূত্র ব্রিজ হয়ে পাড় হয়ে নান্দাইল চৌরাস্তা, সেখান থেকে আঠারোবাড়ি হয়ে কেন্দুয়ায় গিয়ে সকালের নাস্তা সেরে জালাল খাঁর বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য থাকলেও ভূল নির্দেশনায় আমরা মদন এর দিকে অর্থ্যাৎ উল্টো দিকে ১০ কিমি চলে গেলে মন খারাপ হয়। না ফিরে সামনে যাওয়ার ই সিদ্ধান্ত নিই। পরে সেখানে যাওয়ার মনস্থির করি।

সাঁইঢুলি

 
সরিষা হলুদ শুষ্ক সাঁইঢুলি ছাতি বেয়ে কিনার ধরে মদনের বিখ্যাত মাজার হয়ে খালিয়াজুড়ির মুখ। মদনের উচিতপুর থেকেই হাওরের ভূমিকা। 

ধনু নদীর পার ঘেষে জগন্নাথপুর এর ছোট বাজার ঘেষা গ্রামের কর্মমেদুর পাড়া ঘেষে রসূলপুর ঘাটে ধনুর ফেরি পার হয়ে হাওরের ঢালাই পথে পৌছি খালিয়াজুড়ি।


পথ পাশের বৃক্ষতলে পরিত্যক্ত মূর্তির দেবতাগণ, গরুচড়া বিস্তৃত মাঠ, প্রাকৃতিক পুষ্ট ঘাসের বাওয়াল, ঘোড়াচুলি হাওর, কাওর বান্দা হাওর সহ নানা নাম না জানা হাওর পাড়ি দিয়ে আমরা পৌছি স্থলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছোট চর উপজেলাটিতে। 


চা বিরতি, যান বিশ্রাম পরে সুনামগঞ্জের এদিককার এন্ট্রি পয়েন্ট শাল্লা দিয়ে গন্তব্য দিরাই। ১১ উপজেলার ০৯ টিতেই এ যাত্রায় আমাদের পা পড়েছে। দিরাই এ শাহ আব্দুল করিম এর বাড়ি। সদর থেকে ৭ কিমি।


বিকেলের রক্তিম আভায় হাওর এর মাঝ দিয়ে কংক্রিট এর রাস্তা ধরে কালনি ঘাটে শাহ আব্দুল করিম মিউজিয়াম। কালনির শূণ্য ঘাটপাড়ে করিম নৌকা বাঁধা।

মিউজিয়াম এর পিছনে চিরনিদ্রায় শায়িত গানের পাখি আর কবিপ্রেম সরলা। এখনও কি করিম উদাস হন!  কালনির ওপারে এই শুকনো প্রান্তরেও  জলের থৈ থৈ ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি কি চোখ বন্ধ করে মন্থন করেন! 

মিউজিয়াম 

বিষাদের প্রেম পাখী থেকে বিদায় নিতে সন্ধ্যা ঘন হয়ে  আসে। দিরাই এ নিশিযাপন করে (আবাসনের ব্যবস্থা এর চেয়ে মন্দ আরো হয় কি না জানা নাই, তবে করিমখানাতেও থেকে যাওয়া যেতো) পৌষ কুয়াশায় কালনিসেতু পাড় হয়ে ধামাইল স্রষ্টা রাধারমনপাড়ে পৌছতে ভাঙাচোরা ঢালাইপথ, আইল পথ, হাওর, চেরাচেপ্টি নদী, আর পাড়ি দিতে হয় বোয়াল, আইর নিবাস মহাত্মা নওল্লার হাওর। কষ্টের আনন্দ গালিব জানে।

নওল্লার হাওর 


আঠারো শতকের রাধারমনের সর্বস্ব নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে তার নিশানা। জমি-জমা সব যার যার মতো বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন বঙ্গসন্তান। 

সমাধি মন্দির এর ভিতরভাগ

পরিবার পরিজন দেশত্যাগ করেছেন বাটোয়ারার বছর। তারপর কাঁটাতার পাসপোর্ট ভিসার বাঁধায় হারিয়ে গেছে তার রক্তের ফুল। অতটা আলোয় পাছে চারপাশ আলোকিত হয়ে কারো চোখ ধাঁধিয়ে যায়, দৃষ্টিশক্তিতে চাপ পড়ে!

 
দত্তকে মুর্শিদজ্ঞান করা ভক্ত দত্তের খড়ম বুকে নিজ ব্যায়ে বাড়ির উঠোনে পুকুর পাড়ে গড়েছেন ছোট্ট সমাধি মন্দির।

রাধার ঘর আশপাশে কোথাও ছিলো অতটুকু তৃপ্তি, আর চির বিচ্ছেদ - "আগে যদি জানতামরে ভ্রমর....." বুকে নিয়েই ফিরতে হবে প্রেমিক কে।


রাধা রমন এর থেকে আমাদের যাত্রা আঠার শতক এর আরেক গীতিকবি সুনামগঞ্জ সদরে সুরমা পারের হাসন রাজার দরবার। 

বংশধরেরা নতুন বাড়ি করলেও টিনের দুটো ঘর এখনও টিকে আছে। রাজগৃহ জঙ্গলাকীর্ন, জলসাঘর প্রয়াত। সুরমার উপচে পড়া জলের ছোবলে হাসন মিউজিয়ামের মূমুর্ষতা কাঁটেনি এখনও।

পুরাতন গেইট

কালের ভাঁজে সুরমার পলি শক্ত হয়ে বাড়ির পাশে হয়ে গেছে মাটি। বস্তি, স্কুল, দালানের জংলা হয়েছে সেখানে । বাড়ির পাদপাশেই তাহিরপুর টাঙ্গুয়ার হাওর এর সুরমা ঘাট। এ ঘাট থেকেই রিজার্ভে মিলে নানা মাত্রার বিহার বুট।


দুপুরের খাবার সেরে ছোট্ট মিউজিক বক্স কিনে সুরমা পার হয়ে লাউডে গান শুনতে শুনতে শনির হাওর সহ নানা নাম না জানা হাওর পাড়ি দিয়ে তাহিরপুর। মাঝপথে মহাসিং নদীর তীরে শতোর্ধ দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদ দর্শন।

 তাহিরপুরে চা-যান বিরতি দিয়ে সন্ধ্যার মাটিকাটা হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর সহ নানা হাওর নদী পাড়ি দিয়ে মেঠোপথ বেয়ে ঘন সন্ধ্যায় মেঘালয়ের পাহাড়ের পাদদেশে বড়ছড়ার বাজারের মাঝারি হোটেলে কুয়াশার্ত নিশীযাপন।

 
সকালে বড়ছড়া শুল্কস্টেশন এর মনোরম পাহাড়ি পথ হয়ে বড়দিনের আমেজ ছোট্ট নতুন পাহাড়ি গির্জা রেখে শাহ আরেফিন এর আস্তানা উদ্দেশ্যে বারিক্কা টিলার পাদদেশ থেকে যাদুকাঁটার ঘাট থেকে নৌকাযোগে ওপারে আস্তানায় পৌছি। 


বড়ছড়া থেকে মাইল ছয়েক পাহাড়ি পথ আর ওপাড়ে আস্তানাপাশেই বর্ডার হাঁট। 

বর্ডার হাঁট 

তরফ বিজয়ের সময় হযরত শাহ আরেফিন (র.) হযরত শাহজালাল (র.) সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের (র.) সঙ্গী ছিলেন। তিনি লাউড়েরগড় যাওয়ার সময় বর্তমান সুনামগঞ্জের যে স্থানে রাত্রি যাপন করেছিলেন, সে স্থান পরবর্তী সময়ে আরফিননগর নামে অভিহিত হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পরে তিনি লাউড়েরগড় গ্রামের কাছে খাসিয়া পাহাড়ের কাছে আস্তানা গাড়েন এবং তদানীন্তন লাউড় রাজ্যে ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। 

আস্তানা থেকে মাইলখানেক পরে পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত লাউড়ের গড়। ময়মনসিংহ সুনামগঞ্জ নিয়ে গঠিত এই রাজ্যের ধ্বংসাবশেষও নদীগর্ভে বিলিয়মান।
লাউড়েরগড় থেক অনতিদূরে ঐতিহাসিক পণাতীর্থ। 

পূর্বপাড় এর মন্দির

কুবের আচার্য এবং নাভা দেবীর পূত্র কমলাক্ষ।
শ্রীশ্রী অদ্বৈতাচার্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম কমলাক্ষ। তিনি নবদ্বীপে শিক্ষালাভ ও শান্তিপুরে অধ্যাপনা করেন। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তার নাম দেওয়া হয় অদ্বৈত। পঞ্চদশ শতকে তিনি 'চৈতন্যবিষয়ক পদ' রচনার সূত্রপাত করেন। তিনি বৈষ্ণব সাহিত্যে শ্রীশ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভু হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। লাউড়ের রাজা স্বয়ং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে 'লাউড়ের কৃষ্ণদাশ' হন। অদ্বৈতের মতো তীর্থরাও 'পণ' করেছিলেন, প্রতি বারুণীতেই সেখানে তাদের আবির্ভাব ঘটবে। এই 'পণ' শব্দ থেকেই পণাতীর্থের নাম হয়েছে। এই পণাতীর্থকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূণ্যস্থান মনে করেন। এই পণাতীর্থকে কেন্দ্র করে চমৎকার এক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
নদীর উভয় পাশে পণাতীর্থকে কেন্দ্র করে দুইটি মন্দির রয়েছে। মন্দিরে অনেক মানুষের সমাগমহেতু অনেক আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে। যে কেউ এখানে সাদরে আতিথ্য গ্রহণ করতে পারেন; বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বিরা। নদী পারাপার এর ঘাটটিতে সেতু নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

পশ্চিম পাড় এর মন্দির

ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে একইসাথে তিনদিন ব্যাপী শাহ আরেফিন এর আস্তানা এবং পণাতীর্থকে কেন্দ্র করে বিশাল উৎসব চলে এখানে। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য অনবদ্য। বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা এখানে যাদুকাঁটা নদী কেন্দ্রিক।

বালি খুড়ে পাথর, কয়লা, জ্বালানী উত্তোলন এবং তা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন বিশেষত খরস্রোতা এ নদীর মেজাজের উপর ই নির্ভরশীল। একসাথে এত নৌকাযোগে এতো বড় কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশ আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নাই।

লাকমাছড়া

দুপুরে ফিরে বড়ছড়া বাজারে খেয়ে  নিলাদ্রি লেক হয়ে পাশেই লাকমাছড়ার পাশে সন্ধ্যা । হোটেলে ঘন্টাখানেক দিনের ধূলো মুছে ছোট বাজারে পায়চারি, শীতার্ত চা স্টলে মানুষের আড্ডা আলাপে ঢুকে যাওয়া। রাতের খাবার খেয়ে মিউজিক শুনতে শুনতে ঘুম।

 
ভোরের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কুয়াশা আর মেঘের ডুয়েট প্রতিপক্ষের হুমকি উপেক্ষা করে তৃতীয় দিন সাতটার ভিতরে পশ্চিমমুখী বর্ডার রোডে বাইক চাপিয়ে মহিষখোলা পৌঁছাতে ঘন্টাখানেক। কাঁচাপাকা রাস্তার ডানপাশে পাহাড় বামে হাওর। দূর্গাপুর থেকে মহিষখোলা হয়ে আরেকবার এ পথে আমার ট্যাকেরঘাট যাওয়ার অভিজ্ঞতা চমৎকার দূর্ধর্ষ।


মহিষখোলা চৌমুহনি থেকে বামে মোড় নিলে টাঙ্গুয়ার হাওর এর পশ্চিমপাড় ঘেষে যুদ্ধবিদ্ধস্ত রাস্তা ধরে মধ্যনগর পর্যন্ত ১০ কিমি এর মতো পথ। ইটের সলিং এর এই রাস্তার ইটগুলো সাজিয়ে পথ তৈরির বদলে যেন স্তুপাকারে যথেচ্ছার করে প্রতিবন্ধকতা তৈরিই ইটার্ত পথের ইটষ্কাম। ১০ কিমি পথ পাড়ি দিতে সময়ের পরিমাণ ঘন্টাতিরিক্ত, আর মনোপেশিজ উত্তেজনা। মাঝপথে শুষ্ক হাওড়ে সরিষার বাগ।


 মিনিটপাঁচেক এক অনাবৃষ্টি যেন এই পথকে স্মরণীয় করে তোলার প্রাকৃতিক ব্যাঙ্গের চূড়ান্ত কান্ড। আরও কিছু সিক্ত পথহীন পথ, সুমেশ্বরীর বাঁশের সাঁকো পাড়ি দিয়ে মধ্যনগর বাজার। এখানেও সেতু নির্মাণের কাজ চলমান। হাওর বাঁধের উপর দিয়ে মধ্যনগর বাজারপাড়ের ঘাট থেকে ফেরি পাড় হয়ে সোজা ১০ কিলো পরে গাছতলা বাজারে সকালের নাস্তা। মধ্যনগর পৌছার অধিকতর সুশ্রী পথটা তাহিরপুর হয়ে। ও পথে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত ই উত্তম।

 
এখান থেকে ডানপাশের রাস্তা ধরে ময়মনসিংহের শর্টকাট। এই রাস্তা ধরেও টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার আরেকটি লিখায় আছে । বাম পাশেরটি ধরে ময়মনসিংহ যাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে আরও একটি লিখায়। এইবার নিয়ে ট্যাকেরঘাট যাওয়া আমার চারবার এবং  চারবার ই ভিন্ন পথে।


বামপাশের রাস্তা ধরে বাদশাগঞ্জ ধর্মপাশা হয়ে এবারের গন্তব্য উকিল মুন্সির বাড়ি। গুগল ম্যাপের বিভ্রান্তিকর পথ ধরে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পড়ি বিখ্যাত ডিঙ্গাপোতা হাওরে। ঋষিগণের ধ্যানে কৃষিযজ্ঞ মাঠজুড়ে। এখান থেকে যেতে হয় উকিলমুন্সি বাজারে। বাজার থেকে সোজা মাইলখানেক। এই হাওরে পথ হারিয়ে ক্ষণিক বিরক্তও হই, গুগল মাথা ছাড়ে। বেশ কিছুক্ষণ আগু পিছু এদিক ওদিক করে ক্লাইম্যাক্স শেষে মিলন দৃশ্য। ভেদাই নদীর পাড়ে টেরাকোটার অলংকারে সাজানো হয়েছে দৃষ্টনন্দন উকিলমুন্সি কমপ্লেক্স, বাঁশের সাঁকো পাড় হয়ে যেতে হয়  ওপাড়ে। 


কমপ্লেক্সে মুন্সি আর মুন্সিপূত্রের যুগল সমাধি। কমপ্লেক্সের কাজ সমাপ্ত প্রায়। পিছনেই কমপ্লেক্স আদলেই করা হয়েছে ছোট্ট নিবাস। বৃদ্ধা মুন্সি পূত্রবধূ থাকেন সেখানে। শুনেছি ওদিক দিয়ে দুটো নদী পার হতে হয় এমন একটি রাস্তা আছে। এক্সপেরিমেন্ট এর সাধ আমাদের ইতিমধ্যেই শোকগ্রস্থ।


 
বিকাল এর সূর্য আমাদের তাড়া দিচ্ছে। ডিঙ্গাপোতার গোলকধাঁধাঁ, আঁকাবাঁকা শীর্ণ পিচের পথ পেরিয়ে আমরা ছুটছি মোহনগঞ্জকে নাকে রেখে। মোহনগঞ্জ বাজার, রেলস্টেশন ছাড়িয়ে চাকা উপযুক্ত পথ পেতেই গতি বাড়তে থাকে। সন্ধ্যাচাবুক পড়ছে পিঠে।

নেত্রকোনা শহর থেকে মাইলখানেক পরে বা আগে নবনির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পিছনে গীতিকবি গুরুর গুরু বাউল রশিদ উদ্দিন এর বাড়ি এবং কবর। 


জালাল খাঁ, উকিল মুন্সি, শাহ আব্দুল করিম এর গুরু এবং গুরুসম মালজোড়ার স্রষ্টা রশিদ উদ্দিন। বিচ্ছেদ এর চেয়ে যার আধ্যাত্মিক গানের সংখ্যা বেশি। আধ্যাত্মিকতায় থাকে সাধনার সুবাস। তার অজস্র গান অন্যের নামে কিংবা অজ্ঞাত  পরচিয় হয়ে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ঘুরছে বাঙাল মুল্লুকে। বাঙালীর আত্মপরিচয়, সবচেয়ে অবহেলিত বাংলার রত্ম রশিদ উদ্দিন এর তৃতীয় পুরুষদের ঋণাত্মক আবেগঘন রসে সন্ধ্যা ভারি হয়ে আসে।

বিদায় নিয়ে আপন নিবাসে নেত্রকোনা সদর হয়ে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ থেকে ত্রিশাল। একটা কড়কড়ে ভ্রমণের যবনিকা।
যৌবন তুমি দীর্ঘজীবী হও। আরো কিছুদিন বাঁচো আমাদের শরীরে। 

সোনাদিয়া : আ ডিজার্টেড আইল্যান্ড

 সময়কাল ২০২৪।  কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর জনাকীর্ন তিনটি পয়েন্ট ডলফিন মোড় থেকে শুরু। প্রথমটি কলাতলী শেষেরটি লাবণী আর মাঝের পয়েন্টটির নাম সুগন্...