যাত্রা বিন্দু যদি ময়মনসিংহ হয়, সে ক্ষেত্রে প্রথম গন্তব্য সুসং দূর্গাপুরে আপনি খুব সহজেই পৌছে যাবেন। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ রাস্তাটা এখন বেশ ভালো। মখমলে রাস্তার দুপাশে অবিরাম উন্মুক্ত প্রান্তরের সবুজ মাঠ, বিল, জলা আর ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর। যথেষ্ঠই ফাঁকা চারপাশটা।
ময়মনসিংহ থেকে শম্ভূগঞ্জ হয়ে শ্যামগঞ্জ। ডানদিকে গেলে নেত্রকোনা আর বামপাশের রাস্তাটা ধরে ছুটলেই পূর্বধলা, জারিয়া ঝাঞ্জাইল ছাড়িয়ে বিরিশিরি। এ পর্যন্ত রাস্তা আপনি যে কোন বাহনেই যেতে পারবেন। ভাগ্য মন্দ হলে বালুর ট্রাক আপনাকে এ পথে বিরক্তি যোগাবে কিছুক্ষণ পর পর। জারিয়ার পর থেকেই মেঘালয়ের পাহাড়গুলো আপনার সামনে দৃশ্যকাব্য হয়ে দেখা দেবে। ময়মনসিংহ থেকে বিরিশিরি দূর্গাপুর এখন সর্বোচ্চ দেড় ঘন্টার রাস্তা। দূরত্ব ৬৫ কিমি।
দূর্গাপুরেও বেশ কিছু দর্শনীয় জায়গা রয়েছে- মেঘালয়ের পাহাড় বেয়ে নেমে আসা সুমেশ্বরি নদী, রাণীখং, বিজয়পুর পাহাড়, চীনামাটির পাহাড়, বাগমারা সীমান্ত, ফান্দা ছড়ার পাশ দিয়ে হেঁটে কিংবা অটো রিক্সা কিংবা বাইকে কোনাফান্দা’র ছড়ার উপরের পাহাড়ের নিচের শস্যক্ষেত। লক্ষীপুর ছড়া ধরে ভিতরে, বর্ডার রোড হয়ে লেঙ্গুরা, লেঙ্গুরা বাজার থেকে বামদিকে সাত শহীদের মাজার ইত্যাদি। সবচেয়ে ভালো হয় একটা দিন দূর্গাপুরটা ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দিলে। নানা জীবন বৈচিত্রের সন্ধান মিলে এখানকার সান্ধ্য বাজারগুলোতে। চূড়ান্ত গন্তব্য যদি টেকেরঘাট হয় তা হলে লেঙ্গুরার পরের জায়গা টুকু লড়াই করেই এগোতে হবে।
লেঙ্গুরা |
লেঙ্গুরা বাজার থেকে টেকের ঘাটের দূরত্ব অল্পই ৫৮ কি.মি। কিন্তু এই দূরত্ব অতিক্রম করতে মাঝখানের বিশ্রাম সহ কমপক্ষে ৩ টি ঘন্টা সময় আপনাকে ব্যায় করতে হবে। কারণ বর্ডার রোড লেঙ্গুরার পরে বেশ খানিকটা এগোলেও তার সংযোগ নেই। কোথাও ব্রিজ হয়েছে তো রাস্তা নেই কিংবা ব্রিজ এর সাথে রাস্তার সংযোগ নেই, কোথাওবা রাস্তা হয়েছে তো ব্রিজ নেই। বর্ষাকালে এই রাস্তায় যাওয়া হারাম 😊।
দূর্গাপুর বাজার থেকে লেঙ্গুরার দূরত্ব ৯ কি.মি.। লেঙ্গুরা বাজার থেকে মেঘালয় থেকে নেমে আসা গুনাই নদীর গুনাই ব্রিজ পাড় হয়ে ওপারে যেয়ে ডানপাশে রাস্তা ধরে নেমে যেতে হবে। ডান দিকের রাস্তা ধরে আপনার প্রথম গন্তব্য হবে রাণীগাঁও বাজার। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ এই পথে অনলি বাইক নো আদার যানবাহন 😉 সরু কাঁচা উঁচু নিচু রাস্তা আর ভোর হলে কুয়াশার পথ পাড়ি দিয়ে মিনিট বিশেক পরেই আপনি পৌছে যাবেন রাণীগঞ্জ বাজার। তারপর সোজা না গিয়ে ডানে মোড় নিতে হবে।
দ্বিতীয় গন্তব্য গোবিন্দপুর। মিনিট বিশেক। একই বৈশিষ্ঠের রাস্তা। মাইল দুয়েক রাস্তা এখানে ইট বিছানো। টেকেরঘাট পর্যন্ত এ রাস্তায় পাহাড় আপনার পাশে থাকবে। বাম পাশে।
রাণীগাঁও এর পথ এর বামপাশ |
তৃতীয় গন্তব্য খাড়নই বাজার। এ পথটা পিচঢালা। রাস্তা ভালো। খাড়নই পৌছার পর আপনার চতুর্থ গন্তব্য বড়ুয়াকোনা বাজার। এখানকার সরু রাস্তাটি পুনরায় আপনাকে বর্ডার রোড এ তুলে দেবে। বর্ডার রোড এর কাজ চলছে (আমাদের যাওয়ার সময়টিতে অর্থ্যাৎ ১৪/১০/২০২১)। বামপাশে মেঘালয়ের মহাদেও অঞ্চল থেকে নেমে আসা মহাদেও নদীটি পার হতে হবে নৌকা দিয়ে। ফেরার পথে আমরা টাকনু জলে বাইক হাঁটিয়েই পাড় করেছিলাম। বড় নদী। এপাশে বিজিবি ক্যাম্প ওপাশে সোজা বর্ডার রোড। ব্রিজ এর কাজ শুরু করতে হবে খুব শিঘ্রই, তখন নদীতে বাঁধ দেবে, হেঁটে কিংবা বাইক চালিয়েই যাওয়া যাবে।
যাওয়ার সময় আমাদের এখানে প্রায় ৪০ মিনিট সময় বেশি ব্যায় হয়েছে। আমরা ভোর ৬ টায় রওনা দিয়েছিলাম, ঘাটে পৌছি ৭:৩০ এর দিকে। নৌকার মাঝি তখনও আসেনি। তবে পৌছার মিনিট দুয়েক এর মাঝে মাঝি আসলেও বালুর স্তর কেঁটে নৌকার রাস্তা করতে করতে লেগে যায় মিনিট ৩০। এই ঘাটটি বিজিবি ক্যাম্প থেকে ডানের রাস্তা ধরে বাজার পার হয়ে। আর ক্যাম্প থেকে বামের রাস্তাটি পাতলা বন এর। এই ঘাট থেকে বাম দিকে মেঘালয়ের পাহাড়ের বেশ সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ে।
নদী ধরে সোজা যেখানে পাহাড় তার পাদদেশেই পাতলাবন |
আমরা যে সময়টাতে গিয়েছিলাম তখন দূর্গাপুঁজা চলছে। অষ্টমির দিন। এ দিকের বাংলাদেশের শেষ জায়গাটার নাম পাতলাবন আর বর্ডারের ওপাশে সাউথ গারো হিল এর অঞ্চলটির নাম মহাদেও। টেকেরঘাট থেকে ফেরার পথে দুপুর গড়িয়ে যখন বিকাল প্রায় তখন পাতলাবন এর দিকটায় গিয়েছিলাম আগ্রহ নিয়ে। বিজিবি ক্যাম্প থেকে বামদিকে কাঁচা রাস্তা ধরে মাইল দুয়েক। কিন্তু গিয়ে হতাশ হই। একেবারে কিছুই নেই। সরকার তরফ থেকে গারোদের কিছু ঘরবাড়ি করে দেয়া হয়েছে ওখানে । কিন্তু বড় একটি পাওয়া যোগ হয় যখন জানতে পাই ওদিক দিয়ে দূর্গাপুজার উপলক্ষে মেঘালয়ে যাওয়ার পথ অঘোষিত উন্মুক্ত।
হাইস্কুল মন্দির সংলগ্ন খেলার মাঠ; ওয়েস্ট গারো হিল, মেঘালয় |
মন্দির চত্বর থেকে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা মহাদেও নদী |
কয়েক ঘর মাত্র বাঙালী হিন্দু। কয়েক বছর অস্থায়ী মন্দিরে পুঁজো হলেও এবার স্থায়ী মন্দির উঠেছে। মন্দিরে পুঁজো দেখা, প্রসাদ খাওয়া এবং ছোট বাজারটিতে কিছুক্ষণ সময় কাঁটিয়ে নানা মানুষ জীবন প্রণালী দেখে, দু’য়েকটি জিনিস কেনাকাটা করে সন্ধ্যার আগেই আমরা বাংলাদেশে ফিরে আসি। আমার এ যাত্রায় সঙ্গি হয়েছিলো একেবারেই অজানা তিনজন মানুষ।
দুই গলি আর লম্বা একটি পাকা ছাউনির বাজারটিতে নিত্য প্রয়োজনীয় জামা, জুতো, খেলনা, গ্রোসারি, ওষুধ, মাছ, মাংস, শুটকি, খেলাঘর, একটি ছোট রাইস ওয়াইন আর পানিয়র দোকান। আড্ডা আর পারিবারিক আবহ বাজারজুড়ে।
মহাদেও বাজার একপাশের গলি; ওয়েস্ট গারো হিল, মেঘালয়। |
কয়েকজন স্থানীয় ছাড়াও বিএসএফদের সাথেও আমাদের কথা কুশল বিনিময় হয়। ক্যাম্পের পাশ দিয়ে ফেরার সময় তারা আমাদের যথেষ্ঠ আন্তরিকতার সাথে বিদায় জানায়। কিছু মধুর স্মৃতি নিয়ে আমরা ফিরে আসি।
লেট্স ব্যাক টু দ্য জার্নি।
ফেরি পার হয়ে পরবর্তী গন্তব্য পাঁচগাঁও নতুন বাজার এর দিকে যেতে শুরু করি। এটাই পঞ্চম গন্তব্য। পাঁচগাঁও কলমাকান্দার সীমান্তের মেঘালয়ের পাহাড় ঘেষা একটি জায়গা। বর্ডার রোডস্থ পাঁচগাঁও বিজিবি ক্যাম্প এর পাশদিয়ে কলমাকান্দা পর্যন্ত একটি পাঁকা রাস্তা এখান থেকে ডান দিকে চলে গেছে। কলমাকান্দা থেকে আবার দূর্গাপুরের দূরত্ব ২৬ কিমি। এই পথ ধরে অনেকেই এখন দূর্গাপুর থেকে পাঁচগাাঁও বেড়াতে যায়। তবে দূর্গাপুর থেকে কলমাকান্দা পর্যন্ত এই রাস্তার স্বাস্থ্য মুমুর্ষ বলে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি।
পাঁচগাঁও |
এখানে তিনটি রাস্তা। ডানের টি মধ্যনগরের দিকে, বামেরটি বর্ডার রোডের দিকে আর সোজা রাস্তাটি বর্তমানে ভোলাগঞ্জ এর ভালো রাস্তা। এই রাস্তাটিকে এলাকাবাসি নিচু রাস্তা বলে। কারণ, এটি বর্ষায় ডুবে যায়, শুকনোয় ভেসে উঠে। ভেসে উঠলে এটি দিয়েই সবাই যাতায়াত করে। এটি ঢালাই রাস্তা। এ রাস্তা ধরে সময় অপেক্ষাকৃত কম লাগে।
বর্ডার রোডটিই ভবিষ্যতে টেকেরঘাট এর সাথে যোগাযোগ এর প্রধান রাস্তা হবে। কিন্তু এখনও বেশ খানিকটা কাজ বাকি। আশা করা যায় বছর দুয়েক এর মধ্যে পুরো বর্ডার রোডটি হয়ে যাবে। তখন দূর্গাপুর থেকে স্বল্প সময়ে কোন মেঠোপথে না গিয়ে বিনা ঝামেলায় সোজা পাকা বড় রাস্তাটি ধরে এ অঞ্চলের মানুষ টেকের ঘাট হয়ে সিলেট কিংবা অন্যান্য অঞ্চলে যাওয়া আসা করতে পারবে।
মহিষখোলা বাজার থেকে ভোলাগঞ্জ হয়ে বীরেন্দ্রনগর পর্যন্ত পড়বে পথের বাম পাশে পাহাড়, ডানপাশে হাওড়, কাঁচা পাকা রাস্তা ব্রিজ ছোট ছোট কালভার্ট; কোনটা বা বাঁশের তৈরি । সব পার হয়ে বীরেন্দ্রনগর পৌছতে মিনিট ত্রিশেক। বীরেন্দ্রনগর বাজারের সাথেই বিজিবি ক্যাম্প, এর সামনেই একটি মাঝারি ব্রিজ। এই নদীটিও মেঘালয় থেকে নেমে আসা। মেঘালয় থেকে মাঝারি ট্রলার বোঝাই পাথর নিয়ে আসা ট্রলারগুলোর ব্যাস্ততা এখানে চোখে পড়বে।
বীরেন্দ্রনগর ঘাট |
বীরেন্দ্রনগরের পরে চারগাঁও হয়ে উত্তর শ্রীপুর, সেখান থেকে লাকমাবাজার হয়ে টেকেরঘাট পুরো পথটিতেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র আর মানুষের জীবন জীবিকার অনুরনন চোখে পড়বে। একটু খুঁটিয়ে জহুরির মতো চিনে নেয়ার, দেখে নেয়ার ক্ষমতা ব্যক্তি ভেদে আলাদা হবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা সাড়ে দশটা নাগাদ ওখানে পৌছে লাকমাছড়ায় গোসল, বিশ্রাম, আর শরবত পান করে নিলাদ্রি হয়ে বড়ছড়ার শুল্ক স্টেশন এর দিকে যাই।
বড়ছড়া শুল্ক স্টেশন |
বড়ছড়ার এই শুল্ক স্টেশন অত্যন্ত ব্যস্ত জায়গা। এই স্থান দিয়ে মেঘালয় থেকে প্রচুর পরিমাণে পাথর বাংলাদেশে প্রবেশ করে। টেকের ঘাট নিলাদ্রি থেকে এই স্থানের দূরত্ব ১ কিলোমিটারের মতো। কেউ যদি টেকেরঘাট এ রাত্রি যাপন করতে চান, তাহলে বড়ছড়া বাজারেই মাঝারি মানের থাকার হোটেল পেয়ে যাবেন। টেকেরঘাট এ দুয়েকটি দিন কাটানোর মতো উপযুক্ত জায়গা যথেষ্ঠ আছে।
বড়ছড়া থেকে ১২.৩০ এর দিকে ফিরে ( দিন পনের আগেই যেহেতু আমরা ট্রলারে করে টেকেরঘাটে গিয়েছিলাম তাই অন্য কোথাও যাই নি) টেকেরঘাট বাজারে দুপুরের খাবার খেয়ে ১:১৫ টার মধ্যে রওনা দিই। যা বলেছিলাম, পড়ে ওয়েস্ট গারো হিল এল বাজারটিতে ঘুরে ৮ টার মধ্যে দূর্গাপুর ফিরে আসি।
দূর্গাপুর থেকে দিনে গিয়ে দিনেই দূর্গাপুরে ফিরে আসা যায়, তবে একটা দিন ওখানে থেকে গেলে আরো বেশি ভালো লাগবে। বর্ডার রোড এর কাজ শেষ হয়ে রাস্তাটি চালু হয়ে গেলে, দূর্গাপুর থেকে বর্ডার রোড ধরে টেকেরঘাট হবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের জন্য পাহাড়, সীমান্ত, হাওড়, নদী, ছড়া, লেক এর মিশেলে দারুন আনন্দদায়ক এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র। এটিই হয়ে উঠতে পারে তখন এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান পর্যটন স্পট।
টেকের ঘাট গিয়ে আরও কি কি দেখা যায় তা আমার ‘প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য : টাঙ্গুয়ার হাওড়, নিলাদ্রি, লাকমাছড়া, বারিক্কাটিলা, জাদুকাঁটা নদী।’ ব্লগটিতে বিস্তারিত লিখেছি। আগ্রহীরা সেখান থেকে পড়ে দেখতে পারেন।
বি:দ্র: এই ব্লগে লিখিত অভিজ্ঞতা, ছবি সবই লেখকের নিজের। কেউ এই অভিজ্ঞতা কিংবা ছবি নিজের বলে চালিয়ে দিলেও লেখকের কোন আপত্তি থাকবে না।😊